ডেস্ক রিপোর্ট: জগন্নাথ কলেজ থেকে ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ৬ জন উপাচার্য নিয়োগ হয়েছে। বিগত উনিশ বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যাশিত অগ্রগতি লাভ করেনি। এর অন্যতম কারণ হিসেবে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে উপাচার্য নিয়োগ না হওয়াকে দায়ী করা হয়। এসব উপাচার্য তাদের রুটিন দায়িত্ব পালন করেছেন ঠিকই, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের মৌলিক সমস্যা সমাধানে তাদের ভূমিকা নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। এমনকি দুর্নীতির অভিযোগ আছে দায়িত্ব পালন করা একাধিক উপাচার্যের বিরুদ্ধে।
বিগত উপাচার্যরা শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের তেমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ না নেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন না করা, আবাসনের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ না নেওয়ার কারণে বাহিরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপাচার্য হিসেবে দেখতে চান না শিক্ষার্থীরা। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থেকে উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে রোববার ক্যম্পাসে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ব্যাতিত অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যদি কেউ জবির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে তাকে ক্যম্পাসের প্রধান ফটক থেকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি প্রদান করেন শিক্ষার্থীরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাসুদ রানা বলেন, আমাদের উপাচার্য হিসেবে যাকেই নিয়োগ দেওয়া হোক তাকে অবশ্যই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হবে। তবে এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, সকল শিক্ষকেরা পাঁচ আগস্টের আগের দিন পর্যন্ত ছাত্র সমাজের আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে, শিক্ষার্থীদেরকে নানান ট্যাগ দিয়ে বিপদে ফেলতে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে তাদের উপাচার্য হওয়ার শত যোগ্যতা থাকলেও তাদের উপাচার্য নিয়োগ দিলে ছাত্রসমাজ কখনোই মেনে নিবে না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যারা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়েছে, তাদের মধ্য থেকেই আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দেখতে চাই।
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, এই মুহুর্তে ক্যম্পাসে এমন কোনো শিক্ষক পাওয়া যাবে না যারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নেই। তাই কে বা কারা উপাচার্য হবে, তার জন্য অবশ্যই সর্বপ্রথম আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের সহায়তাকারী শিক্ষকদের বাদ দিতে হবে উপাচার্য হওয়ার তালিকা থেকে, সে যতই যোগ্য হোক না কেন।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যারা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে তাদের মধ্য থেকেই আমরা আমাদের অবিভাবক চাই। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যে দাবিগুলো আছে প্রশাসনের কাছে, সে দাবিগুলো যে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারবে অবশ্যই সে আমাদের উপাচার্য হবেন।
উপাচার্যে হওয়ার আলোচনায় আছেন যারা-
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থেকে উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম।
তিনি ১৯৮৬ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০০৮ সালে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান ও সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল রুলস রেগুলেশন তৈরিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
শিক্ষার্থীদের মাঝে আলোচনায় দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের অধ্যাপক ড. পেয়ার আহমেদ। ২০১২ সালে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। পরে ২০১৮ সালে বিজ্ঞান অনুষদের ডীন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৯ সালে গ্রেড -১ অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, একাডেমিক কাউন্সিল সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের রুলস এন্ড রেগুলেশন প্রণয়ন সদস্যসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
ড. পেয়ার আহমেদ এর আগে, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা ক্যাম্পাস), আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়ামাগাটা বিশ্ববিদ্যালয় (জাপান) সহ দেশ ও দেশের বাইরে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ক্যাম্পাসে তিনি একজন সুবক্তা, স্পষ্টবাদী, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। দেশী -বিদেশী জার্নালে তাঁর ৪০ টির বেশি গবেষণা পত্র রয়েছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর লেখা কয়েকটি পাঠ্য-পুস্তক রয়েছে।
এছাড়া উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে আলোচনায় তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে আছেন, ফিন্যান্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু মিছির। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কর্পোরেট ফাইন্যান্সিয়াল পলিসিস-এ পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। এর আগে তিনি ঢাবি থেকে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। এছাড়া তার দেশও দেশের বাইরের বিভিন্ন জার্নালে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিকট সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও উদার হিসেবে পরিচিত তিনি।
আলোচনায় চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে আছেন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ নিস্তার জাহান কবির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা নিস্তার জাহান কবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ও অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল সম্পন্ন করেন তিনি। এছাড়া দেশি বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে তার লেখা শতাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করেন। সর্বশেষ ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পালানোর দিনও শাহবাগে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
এদিকে পঞ্চম ব্যক্তি হিসেবে উপাচার্য হওয়ার দৌড়ে রাজনৈতিক তদবিরে এগিয়ে আছেন জবি বিএনপিপন্থী সাদা দলের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দিন। সাদা দলের সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও তিনি সারাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘ইউনিভার্সিটি টিচার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ইউট্যাব)- এর কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব। কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্বিবদ্যালয় শাখা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রইছ উদ্দিনের সঙ্গে রয়েছে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বলেন, সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হতে হলে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। দুটি চেয়ারের একজন যদি একাডেমিশিয়ান হয়, অন্যজনের পলিটিক্যাল জ্ঞান থাকতে হবে। এতে একদিকে গবেষণা, শিক্ষা ও শিক্ষকের মান ঠিক থাকবে, অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে সবাইকে একত্রিত রাখা ও বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা আনা সহজ হবে।