ব্যুরো এডিটর……
খুলনার বড়বাজারে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও তবু হুঁশ নেই যেন কারও। সেই আগের মতোই এখনো অপ্রশস্ত সড়ক।
মার্কেটে ঢোকার পথ সরু। দিনরাত রাস্তার দুই ধারে ভিড় করে থাকেন হকার ও ক্রেতারা। বেশির ভাগ পুরনো মার্কেটের বাইরেই এমন দৃশ্য। এই ভিড় ঠেলে ভেতরে যেতে বেগ পেতে হয়।
এক গলি দিয়ে ঢুকলে অন্য গলি দিয়ে বের হতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় জনসাধারণকে। অধিকাংশ মার্কেটে নেই কোনো অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এসব মার্কেটে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে রাজধানীর নিমতলী কিংবা চকবাজারের চুরিহাট্টার চেয়েও বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে বলে এ বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান।
মার্কেটের মালিকপক্ষকে বার বার বলেও কোনো সমাধান না হওয়ায় জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়েই চলছে বেচাকেনা। মার্কেটে রাতের বেলা গেটগুলো বন্ধ থাকে। তখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে মানুষের বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প হলে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও জানমালের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ বিধিমালা অনুযায়ী ফায়ার এক্সিট, ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেক্টরের (ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্র), সেফটি ট্যাংক নেই। এছাড়া নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় কনটিনজেন্সি প্ল্যান রাখা জরুরি হলেও সেই ব্যবস্থা নেই।
খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বৃহৎ প্রাচীন বাজার বড়বাজারের গোড়াপত্তন হয় প্রায় দুইশ বছর আগে। খুলনা মহানগরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদের পাড় ঘেঁষে ওয়েস্ট মেকড রোড, ভৈরব স্ট্যান্ড রোড, হেলাতলা রোড, কালীবাড়ী রোড, ক্লে রোড, কেডিঘোষ রোড, স্যার ইকবাল রোডের একাংশ ও স্টেশন রোড নিয়ে বড়বাজারের অবস্থান। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বড়বাজারের নাম ছিল ‘চার্লিগঞ্জ’ বা ‘সাহেবের হাট’। নীল কুঠিয়াল চার্লস এ বাজার প্রতিষ্ঠার কারণে তার নামেই নামকরণ হয় বাজারটির। বাজারটিতে বর্তমানে ছোট-বড় ১০ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সব ধরনের পোশাক ও পণ্য এবং খাদ্যদ্রব্য পাইকারি বেচাকেনার পাশাপাশি খুচরা বিক্রি হয় এ বাজারে। যে কারণে লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন ভিড় করেন বাজারটিতে।
সবশেষ বুধবার (৭ ডিসেম্বর) রাতে খুলনা মহানগরের খাজা খানজাহান আলী হকার্স মার্কেটে আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে মার্কেটের ৩টি দোকান পুড়ে গেছে।
পরে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে খুলনা শপিং কমপ্লেক্স লাগোয়া রহিমা কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট আধাঘণ্টা চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। সে সময় ওই ভবনের বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
৫ অক্টোবর খুলনার বড়বাজারের ডেল্টাঘাট এলাকায় আগুনে ৭টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কারখানা পুড়ে গেছে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। আগুনে ২ কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা।
২০২০ সালের ১৯ জুলাই রাতে রেলওয়ে হাসপাতাল রোডে (নিক্সন মার্কেট) অবস্থিত মানিক মিয়া শপিং কমপ্লেক্সের এলাহি ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে আনুমানিক ৬৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে দাবি করেন ক্ষতিগ্রস্তরা। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও সচেতন হচ্ছে না ব্যবসায়ীরা।
আক্ষেপ করে ফায়ার সাভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন খুলনা সদরের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা একাধিকবার বলে আসছি বড় ধরনের অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে খুলনার বড় বাজার। এ বাজারের মার্কেটগুলোতে অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রী নেই। ফায়ার সার্ভিস এসব মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া চালাতে চাইলেও ব্যবসায়ীরা তাতে রাজি হন না। আশপাশের মার্কেটগুলো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে।
তিনি বলেন, অচিরেই বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অগ্নিনির্বাপণ মহড়া করা হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিউল হক বাংলানিউজকে বলেন, খুলনার বড়বাজার বড় ধরনের অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। যে কারণে প্রতিবছরই একাধিকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রাচীন ও ব্যস্ততম এ বাজারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষায় নির্বাপণ ও প্রতিরোধ দুটোই থাকা জরুরি। এ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক।
সেগুলো হলো—বাজারের মধ্যে কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে পারে এমন প্রশস্ত রাস্তা রাখতে হবে; প্রতিটি বাণিজ্যিক ভবনে জরুরি সিঁড়ি বা ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট রাখতে হবে; ভবনের প্রতি তলায় নিয়মমাফিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা হাতের নাগালে রাখতে হবে; প্রত্যেক কর্মচারীকে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সম্পর্কে মৌলিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে; জ্বলন্ত সিগারেট, ম্যাচের কাঠি যেখানে-সেখানে ফেলা যাবে না; বৈদ্যুতিক তার ও সব ধরনের ইলেকট্রিক সরঞ্জাম নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে; আগুনের ঘটনা টের পেলে সঙ্গে সঙ্গে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিতে হবে; এরপরও আগুন লাগলে দ্রুত নিকটবর্তী ফায়ার সার্ভিসে খবর দিতে হবে এবং সবাইকে সব সময় সচেতন থাকতে হবে।