নির্মাণসামগ্রীর আকাশছোঁয়া দাম মধ্যবিত্তের ফ্ল্যাট কেনার ‘স্বপ্নভঙ্গ’, হিমশিম ব্যবসায়ীরাও

dhaka-city-1-20221114204309.webp

নিজস্ব প্রতিবেদক…

# ফ্ল্যাট বুঝে পেতে গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা
# রিহ্যাবে অভিযোগ দিলে দ্রুত সাড়া মিলছে
# ব্যয় ১০ শতাংশের বেশি বাড়লে সমঝোতা
# ইমেজ সংকট এড়াতে তৎপর রিহ্যাব

রাজধানীর শাহজাহানপুরে দীর্ঘদিন ভাড়া বাসায় থাকেন মো. আসাদুজ্জামান। তিনি একটি কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তার ছেলে ও মেয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। সন্তানদের পড়ালেখার কথা মাথায় রেখে ওই এলাকায়ই স্থায়ী হতে চান তিনি। প্রায় তিন বছর আগে নির্মাণাধীন আবাসিক ভবনে ১৩০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট বুকিং দেন। চুক্তি অনুযায়ী- ফ্ল্যাটের দাম এক কোটি ২০ লাখ টাকা। সম্প্রতি ডেভেলপার কোম্পানি তার কাছে আরও ১৫ লাখ টাকা দাবি করে। বাড়তি টাকা না দিলে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় বলে সাফ জানিয়ে দেন। দরকষাকষির পর বাড়তি আট লাখ টাকায় মিটমাট হয়। আগামী সপ্তাহে ফ্ল্যাট পাবেন আসাদুজ্জামান।

দীর্ঘদিন হলো কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু যথাসময়ের (এক বছর) মধ্যে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়নি। আরও চারজন ক্রেতাকেও তারা (ডেভেলপার কোম্পানি) ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেননি। অজুহাত দেখানো হচ্ছে, রড-সিমেন্টের দাম বেড়েছে। কিন্তু দাম বাড়ার আগেই আমাদের ভবনের কাজ শেষে হয়ে গিয়েছিল। তারা ফ্ল্যাট দিতে দেরি করেছে। এখন নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় বাড়তি টাকা চাইছে।

ডেভেলপার কোম্পানির দাবি, নির্মাণসামগ্রীর দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। চুক্তিপত্রেও উল্লেখ ছিল, কাজ চলা অবস্থায় নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়লে সমঝোতার ভিত্তিতে বাড়তি টাকা নেওয়া হবে। তবে এমন শর্তজুড়ে দেওয়া চুক্তিপত্র দেখাতে পারেনি ওই কোম্পানি।

একই রকম পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন উত্তরায় ফ্ল্যাট বুকিং দেওয়া শিখা আক্তারও। তিনি একটি সরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। চুক্তি ছিল এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। রড-সিমেন্টের দাম বাড়ার অজুহাতে ডেভেলপার কোম্পানি এখন আরও ১২ লাখ টাকা চাইছে। তবে শিখার দাবি, দাম বাড়ার আগেই তার ফ্ল্যাটের কাজ শেষ। তবুও বাড়তি টাকা চাইছে আবাসন কোম্পানি। ফ্ল্যাটে উঠে পড়েছেন শিখা আক্তার। সেখানে বসবাসও করছেন। তবে বাড়তি টাকা পরিশোধ না করায় এখনো ফ্ল্যাটের কাগজপত্র দেওয়া হয়নি তাকে।

শিখা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন হলো কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু যথাসময়ের (এক বছর) মধ্যে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়নি। আরও চার ক্রেতাকেও তারা (ডেভেলপার কোম্পানি) ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেননি। অজুহাত দেখানো হচ্ছে, রড-সিমেন্টের দাম বেড়েছে। কিন্তু দাম বাড়ার আগেই আমাদের ভবনের কাজ শেষে হয়ে গিয়েছিল। তারা ফ্ল্যাট দিতে দেরি করেছে। এখন নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় বাড়তি টাকা চাইছে।’

বাসযোগ্য একটি নগরী গড়তে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যদি কোনো প্রকল্পে ১০ শতাংশ বেশি ব্যয় হয় বা নির্মাণসামগ্রীর দাম ১০ শতাংশের বেশি বাড়ার কারণে আবাসন কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তা ক্রেতা-বিক্রেতা সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করবেন। এখানে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক আমরা তা চাই না।

আসাদুজ্জামান ও শিখা আক্তারের অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। এ নিয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (রিহ্যাব) একাধিক অভিযোগও জমা পড়েছে। অভিযোগ করেছেন উত্তরার ফ্ল্যাট ক্রেতা শিখা আক্তারও।
ইমেজ সংকট এড়াতে তৎপর রিহ্যাব
বসে নেই রিহ্যাবও। ক্রেতা-বিক্রেতার লোকসান ও আবাসন ব্যবসা যাতে ইমেজ সংকটে না পড়ে, সেজন্য এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছে সংগঠনটি। গত ২২ আগস্টের বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়, তা রিহ্যাবের সদস্যদের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়।

এতে বলা হয়, ‘বৈশ্বিক ক্রমঅবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণে মাত্রাতিরিক্ত দামের কারণে চলমান প্রকল্পগুলো আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় নির্মাণাধীন প্রকল্পে যদি ১০ শতাংশের বেশি মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ে, নির্মাণসংশ্লিষ্ট যাবতীয় কাজের বিষয়ে বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে সমঝোতার ভিত্তিতে বর্ধিত বিক্রয়মূল্য পুনরায় নির্ধারণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘কাজ শুরুর পর অতিরিক্ত খরচ (রড-সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব) ১০ শতাংশের কম হলে আগের দামেই কোম্পানিকে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হবে। অর্থাৎ চলমান প্রকল্পের ভৌগোলিক অঞ্চল বা এলাকা (জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশন), প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা বা পর্যায় (স্টেজ অর স্ট্যাটাস), প্রকল্পের অবশিষ্ট নির্মাণকাজের তফসিল (শিডিউল অর ভলিউম অব দ্য রেস্ট কন্সট্রাকশন ওয়ার্কস) ইত্যাদি নির্মাণসংশ্লিষ্ট যাবতীয় কাজের বিষয়ে বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবতার নিরিখে সমঝোতার ভিত্তিতে বর্ধিত বিক্রয়মূল্য পুনরায় নির্ধারণে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’
অভিযোগ পেলেই সমাধান করছে রিহ্যাব
উত্তরায় ফ্ল্যাটের ক্রেতা শিখা আক্তার রিহ্যাবে ডেভেলপার কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। রিহ্যাব নেতারা এটার সমাধান করেন। একইসঙ্গে রিহ্যাবের সিদ্ধান্তও জানানো হয়। পরে শিখা রিহ্যাবের এ চিঠির বিষয়ে ওই আবাসন কোম্পানিকে অবগত করেন। এরপর একমাসের মধ্যেই (চলতি মাস নভেম্বর) আগের দামেই ফ্ল্যাট হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানিটি। শিখার এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিত বাকি চার ক্রেতাও আগের দামেই চলতি মাসেই কোম্পানির নিজস্ব অফিস থেকে ফ্ল্যাটের কাগজপত্র বুঝে পাবেন বলে জানানো হয়।
জানতে চাইলে রিহ্যাবের সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাসযোগ্য একটি নগরী গড়তে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যদি কোনো প্রকল্পে ১০ শতাংশ বেশি ব্যয় হয় বা নির্মাণসামগ্রীর দাম ১০ শতাংশের বেশি বাড়ার কারণে আবাসন কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তা ক্রেতা-বিক্রেতা সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করবেন। এখানে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক আমরা তা চাই না।’

সংগঠনের আরেক সহ-সভাপতি সোহেল রানা বলেন, ‘আবাসন ব্যবসায়ীরা স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবসা করে আসছেন। কোনো ক্রেতা বিপদে পড়ুক বা ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা ব্যবসায়ীরা চান না। ক্রেতার চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখেই কাজ করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। ক্রেতাদের যেকোনো অভিযোগের যৌক্তিক সমাধান করবে রিহ্যাব।’

ইতিহাসের সর্বোচ্চ দামে রড-সিমেন্ট
দেশে ডলার ও জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়েছে নির্মাণখাত। জ্বালানি ও ডলারের দাম বাড়ায় ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামে উঠেছে রড। একইসঙ্গে লাফিয়ে দাম বেড়েছে সিমেন্টেরও। রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ ও সিমেন্ট উৎপাদনের কাঁচামাল ক্লিংকারের পুরোটায় আমদানিনির্ভর।

বাজারে এখন প্রতি টন এমএস রড বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার থেকে ৯২ হাজার ৩০০ টাকায়। এর আগে কখনো রডের দাম এত বেশি হয়নি। একমাস আগেও এসব রডের দাম ছিল ৮৫-৮৬ হাজার টাকা। বাজারে ৫০০ টাকার নিচে কোনো সিমেন্টও নেই। ৫০ কেজির প্রতি বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৫৩০ টাকায়। এর আগে গত মার্চে সিমেন্টের দাম ৫২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। তবে একমাস আগে এসব সিমেন্ট ছিল ৪০০-৪২০ টাকা।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top