নারায়ণগঞ্জে মহাসড়কে এক বছরে ঝরেছে ৭৮ প্রাণ

road-a-1cover-20221022111139.webp

সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি…
ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে সড়কে দুর্ঘটনায় গত এক বছরে নারী-শিশুসহ ৭৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় অনেক পরিবার হারিয়েছে তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। অনেকেই সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করছেন। দুর্ঘটনারোধে সরকারের নানা উদ্যোগেও ততটা সুফল মিলছে না। সড়কে মৃত্যু কিছুতেই যেন কমছে না।
কাঁচপুর হাইওয়ে থানার সূত্রমতে, ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে মেঘনা ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে পুরিন্দা বাজার এবং এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের মদনপুর থেকে কাঞ্চন এলাকা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের অংশে ১৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় নারী-শিশুসহ ৭৮ জন মারা গেছেন। এছাড়া যাত্রী ও পথচারীসহ আরও ১৪৬ জন মানুষ আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় ৭০টির বেশি মামলা হয়।
মহাসড়কে যানবাহনের বেপরোয়া গতি রোধে হাইওয়ে পুলিশের টহল থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী রাস্তা, বেপরোয়া গতির যানবাহন, যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ যান, মোটরসাইকেল চালকের অসাবধানতা ও পথচারীর অসচেতনার কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব সমস্যার সমাধান হলে দুর্ঘটনা অনেকটা কমে আসবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
এদিকে, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবার দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে আসছে। একই দাবি বিভিন্ন সংগঠনেরও। তারা এ দাবিতে বছরজুড়ে সভা ও মানববন্ধন করছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’র নারায়ণগঞ্জের সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল জানান, আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বহুবার মহাসড়কে থ্রি-হুইলার নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছি। প্রথমত, সেটি এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। একই সড়কে যখন বিভিন্ন গতির যানবাহন চলবে তখন সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হবেই। দ্বিতীয়ত, মহাসড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরেও শক্তিশালী করতে হবে। তৃতীয়ত, অসচেতনার কারণেও দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। এছাড়া মহাসড়কে যানবাহন চালকদের প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। যানবাহন মালিকরা যখন চালকদের টার্গেট দিয়ে দেন আজ এতগুলো ট্রিপ দিতে হবে। তখন তাদের মধ্যে এ ধরনের প্রতিযোগিতা বেশি কাজ করে। প্রতিযোগিতায় মানুষ মারা গেলেও তারা এগুলো নিয়ে গুরুত্ব দিতে চায় না তখন। পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’র নারায়ণগঞ্জের সভাপতি ডা. আল ওয়াজেদুর রহমান জানান, আমাদের তথ্যমতে গত এক বছরে সারাদেশে সাড়ে ৫ হাজারের মতো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫ হাজার ৮০০ মানুষ মারা গিয়েছেন এবং ৬ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। আর নারায়ণগঞ্জে দুই শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি দুইশত কিংবা দুজন ব্যাপার না। দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারাচ্ছেন তাদের পরিবারের কাছে এটা কতটা যে দুঃখজনক সেটা তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনই বুঝতে পারে। আমরা তার প্রেক্ষাপটে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে প্রায় ৩০ বছর ধরে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছি। আমরা নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন সময় নিরাপদ সড়কের জন্য মানববন্ধন করার পাশাপাশি প্রশাসনকে স্মারকলিপি দিয়েছি। যাতে করে তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়। আমাদের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার থাকি। যাতে করে ট্রাফিক বিভাগ, জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন বিষয়টির দিকে নজর দেয়। তারা যদি সমন্বিত একটা পরিকল্পনা নেয়, তাহলে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর নারায়ণগঞ্জের মহাসড়কে শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব মহাসড়কে থ্রি-হুইলার ও অবৈধ ইজিবাইক নিষিদ্ধের যে আইন ছিল তা কার্যকর না হওয়ার কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। এছাড়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বরপা অংশের যে জায়গাটি রয়েছে এটি এখনো দুই লেনে উন্নীত হয়নি। এখানে রোড ডিভাইডার না থাকার কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা আরেও বাড়াতে হবে। এছাড়া মহাসড়কের যানবাহনে দক্ষ চালক নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) নারায়ণগঞ্জের সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী মো. শামসুল কবির জানান, ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড অংশে বেশি দুর্ঘটনা হয়। সাইনবোর্ড নিয়ে আমরা একটা প্রতিবেদন তৈরি করে ঊর্ধ্বতন মহলকে জানিয়েছি। এক্ষেত্রে হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা আরেও বাড়াতে হবে। মহাসড়কের অন্যান্য যেসব অংশে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে তা নিয়ে আমরা এখনো প্রতিবেদন শুরু করিনি। আপাতত আমরা সাইনবোর্ড অংশ নিয়ে কাজ করছি।

কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবীর হোসেন জানান, চালকদের অসর্তকতার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হয়। পাশাপাশি অতি দ্রুত মোটরসাইকেল চালানোর ফলেও এসব ঘটনা ঘটছে। এছাড়া কম বয়সী চালকদের দিয়ে ভারি যানবাহন চালানো এবং প্রতিযোগিতার ফলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হচ্ছে না। রাতে মহাসড়কে বৈদ্যুতিক সড়কবাতি না থাকায় চালকদের যানবাহন চালাতে সমস্যা হচ্ছে। বিষয়টি আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। যেসব চালক ট্রাফিক নিয়মগুলো মানেন না আমরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা যানবাহন মালিক সমিতির সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা করেছি কীভাবে দুর্ঘটনা কমানো যায়। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে আমাদের পাশাপাশি বিআরটিএ, সওজ, কমিউনিটি পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top