গর‌মে বাড়‌ছে পানিবাহিত রোগ

water-dissesgdse-2305290232.jpg

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট…
পানিবাহিত রোগে প্রতিদিনই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে বয়স্ক, শিশু এবং বেশিরভাগ সময় ঘরের বাইরে থাকা মানুষেরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রচণ্ড গরমের কারণে রাস্তার ভাজা খাবার এবং ফিল্টার পানির নামে মানহীন পানি পানের কারণে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগবালাই বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা।

গত মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের (২০২১) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ খাবার পানি পায় টিউবওয়েল বা ট্যাপ থেকে। উন্নত পানি পাওয়ার সুযোগ আছে অল্প কিছু মানুষের। এসব খাবার পানি উৎসে ভালো থাকলেও ব্যবহারের সময় বিভিন্ন সমস্যার কারণে পানি দূষিত হয়ে ওঠে। গ্রামাঞ্চলে পানি এক জায়গা থেকে অন্য স্থানে নিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। আবার শহরের অধিকাংশ মানুষ ট্যাপের সরবরাহের পানি বিভিন্নভাবে ফিল্টার করে ব্যবহার করে। গ্রাম ও শহর-সবখানেই পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে দূষণের ঝুঁকি থাকে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গুচ্ছ জরিপে (২০১৯) পানির সংগ্রহ ও ব্যবহারের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। সেই জরিপে দেখা গেছে, পানি সংগ্রহের সময় উচ্চ ঝুঁকির জীবাণুর পরিমাণ থাকে প্রায় ৬ শতাংশ, সেই পানি ব্যবহারের সময় উচ্চ ঝুঁকির জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ শতাংশে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি উৎসে ভালো থাকলেও নানা কারণে এটি দূষিত হতে পারে। এর মধ্যে পরিবহন একটি বড় বিষয়। যেমন ঢাকা ওয়াসার উৎসে পানি ভালো থাকলেও সরবরাহ লাইনের সমস্যার কারণে তা দূষিত হতে পারে। গৃহস্থালিতে পানি রাখার পাত্রের কারণে তা দূষিত হতে পারে। আবার হাত পরিষ্কার না করেই তা পানিতে ডুবিয়ে দিলে পানি দূষিত হতে পারে। অনেক সময় অপরিষ্কার গ্লাস দিয়ে পানি তোলা হয়। এভাবে নানাবিধ কারণে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দূষণ ঘটতে পারে।

পানিদূষণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান খায়রুল ইসলাম বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পানির গুণগত মান অনেক সময় ঠিক থাকছে না। তাই, সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে আরও জোর দিতে হবে।তবেই পানিবাহিত রোগবালাই থেকে মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের তৈরি জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম-জেএমপি প্রতিবেদন ২০২১-এ দেখা যায়, নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে দেশ অনেকটা এগিয়ে থাকলেও পাইপের মাধ্যমে সরবরাহের ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে আছে।পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানিকে বেশি নিরাপদ এবং নাগরিক সুবিধার অংশ বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানি পেয়ে থাকেন, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশের গ্রামের মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ সরবরাহকৃত পানি পেয়ে থাকেন। শহরে এর হার ৩৬ শতাংশ।

সম্প্রতি প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের (২০২১) তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর জন্য যে ১০টি কারণ নিরূপন করা হয়েছে, তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো জন্ডিস। শিশু মৃত্যুর মোট ৮ শতাংশের বেশি হয় জন্ডিসের কারণে। একই বয়সী শিশুদের মৃত্যুর পঞ্চম কারণ ডায়রিয়া। মোট মৃত্যুর ৬ দশমিক ৫০ শতাংশই ঘটে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়।

জন্ডিস বা ডায়রিয়া মূলত পানিবাহিত রোগ। এ দুই রোগে শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে গেছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য বলছে, পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর অষ্টম প্রধান কারণ ছিল জন্ডিস। এতে মোট শিশুমৃত্যুর ২ দশমিক ২ শতাংশ ঘটত। এ সময় জটিল ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেত প্রায় ৫ শতাংশ শিশু।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তাহমিনা খাতুন বলেন, পানিবাহিত রোগের মধ্যে ডায়রিরা, জন্ডিস, আমাশয় এবং টাইফয়েডে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।পানি একটা বড় কারণ হলেও নানা ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবারও এসব রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, শিশুদের মধ্যে যাদের জন্ডিস আছে-তাদের ৮০ শতাংশই হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত। এসব শিশুদের একটা অংশ আবার হেপাটাইটিস ই-তেও আক্রান্ত। এই দুটিই পানিবাহিত রোগ।

শিশুদের সব সময় ফোটানো এবং বিশুদ্ধ পানি পান করানোর পরামর্শ দিয়েছেন এই শিশু বিশেষজ্ঞ। এছাড়া সুতির আরামদায়ক পোষাক, বাইরে গেলে ছাতা ব্যবহার করা, বাইরের কোনো খাবার শিশুদের না দেওয়ার পাশাপাশি স্যালাইন খাওয়ানোরও কথা বলেছেন এই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ।

অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর বলেন, বর্তমানে তীব্র গরম চলছে। যারা কাজের প্রয়োজনে রাস্তায় বা বাইরে থাকেন- বিশেষ করে বিভিন্ন পেশার লোজন; তারা বাধ্য হয়ে গরমের কারণে বাইরের পানি পান করেন। অনেকে তৃষ্ণা নিবারণের জন্য কম দামের ঠান্ডা শরবত পান করেন। এসব পানি বিশুদ্ধ নয় বলে তাদের বিরাট একটা অংশ দ্রুত জন্ডিস ও টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

ডা. ফরহাদ মনজুর বলেন, গরমে যারা বাইরে থাকেন-বিশেষ করে রিকশাচালক, ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা সবসময় বিশুদ্ধ পানি সঙ্গে রাখবেন। মাথায় ছাতা ব্যবহার করবেন। বাইরের খোলা, ভাজা-পোড়া খাবার ও কম দামি শরবত পান করবেন না। গরমে পানিশূন্যতা পূরণ করতে বিশুদ্ধ পানির সঙ্গে খাবার স্যালাইনও খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top