সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট…
ফারুক শেখ ওরফে মো. ফারুক ইসলাম (৪৫)। বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজীরহাট ইউনিয়নের পদ্মবিলা গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক শেখের ছেলে। কর্মরত আছেন উপজেলার ১৫ নম্বর হাজীগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পদবী- সহকারী শিক্ষক।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ঈদের দিন প্রকাশ্যে ঘটে যাওয়া এলাকার একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডে ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামি হন শিক্ষক ফারুক। টানা ৩৮ দিন কারাগারেও ছিলেন। বিধি অনুযায়ী তার সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার কথা থাকলেও হতে হয়নি। এমনকি চারবার আদালতে দাখিলকৃত চার্জশিটে নাম থাকলেও পড়তে হয়নি কোন বিড়ম্বনায়।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজসে পুরো বিষয়টিই ধামাচাপা দিতে সক্ষম হন ফারুক বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে, ধামাচাপা পড়ে যাওয়া ঘটনাটি দীর্ঘ ১০ বছর পর ফাঁস হয়েছে। স্কুল পরিচালনা কমিটির একজন সদস্যের অভিযোগের সূত্র ধরে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে জেলা শিক্ষা অফিস।
শিক্ষক ফারুক শেখের বিরুদ্ধে মামলা এবং কারাগারে যাওয়াসহ সংশ্লিষ্ট প্রমাণপত্র যাচাই করে দ্রুত তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. তৌহিদুল ইসলাম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২০ আগষ্ট ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতর। স্থানীয় পদ্মবিলা গ্রামের ওলিয়ার মুন্সিও (৩০) স্বজনদের সঙ্গে ঈদগাহের দিকে রওনা হন। স্থানীয় রফিক দারোগার বাড়ির কাছে পৌঁছালে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষের লোকজন ওলিয়ারকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনার তিনদিন পর ২৩ আগষ্ট নিহতের মেয়ে দোলেনা বেগম বাদী হয়ে ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে দিঘলিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন (মামলা নম্বর-৭)।
ওই মামলায় হাজীগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফারুক শেখ ওরফে মো. ফারুক ইসলামকে ১৩ নম্বর আসামি করা হয়। পরবর্তীতে দিঘলিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মো. আলী নওয়াজ, জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পরিদর্শক মো. মামুনুর রশিদ, সিআইডি পরিদর্শক প্রবীর কুমার বিশ্বাস এবং সর্বশেষ খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ-সার্কেল) মোহাম্মদ বদিউজ্জামান তদন্ত করে ২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলাটি বর্তমানে খুলনার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এদিকে, আলোচিত এ হত্যা মামলার সব অভিযোগপত্রেই শিক্ষক ফারুকের নাম থাকলেও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন বলে অভিযোগ ওঠে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, শিক্ষক ফারুক ইসলাম উল্লিখিত মামলায় ২০১৮ সালে ৩৮ দিন খুলনা জেলা কারাগারে ছিলেন। এর আগে তিনি একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছয় সপ্তাহের মেডিকেল ছুটি চেয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন। ওই আবেদনের সঙ্গে তৎকালীন খুলনা জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগের মেডিকেল অফিসার সবুজ সাহা স্বাক্ষরিত মেডিকেল সনদ দাখিল করা হয়। যাতে ফকিরহাটের বেতাগা বাজারের তৈয়েবুর রহমান মার্কেটের ‘হেমা মেডিকেল হল’ নামক একটি ফার্মেসির প্যাড ব্যবহার হয়। পরবর্তীতে কারাগার থেকে বের হয়ে তিনি আবারও শিক্ষকতা শুরু করেন।
ঘটনা ফাঁস হওয়ার প্রেক্ষিতে শিক্ষক ফারুকের বিরুদ্ধে অভিযোগের সব প্রমাণপত্রসহ ৩ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে জেলা শিক্ষা অফিস গত বছরের ৬ ডিসেম্বর চিঠি দেন। সে মোতাবেক শুধুমাত্র মামলার কাগজ পাঠালেও কারাগারে থাকার কাগজ পাঠাননি উপজেলা শিক্ষা অফিসার।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে দিঘলিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম বলেন, ‘মামলা ও কারাগারে থাকার বিষয়টি অনেক আগের ঘটনা, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় জেলা শিক্ষা অফিস থেকে শিক্ষক ফারুক ইসলামের মামলা ও কারাগারে থাকার বিষয়ে কাগজপত্র চাওয়া হয়। মামলার কিছু কাগজপত্র ইতোমধ্যেই জেলা শিক্ষা অফিসে প্রেরণ করা হয়েছে। কারাগারে থাকার কাগজটি দ্রুত প্রেরণ করা হবে।’
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘শিক্ষক ফারুক ইসলাম ২০১৮ সালে কারাগারে ছিলেন। তিনি এই তথ্য গোপন করে মেডিকেল সনদ জমা দিয়ে ছুটি গ্রহণ করেন। ফলে বিষয়টি গোপন থেকে যায়। কিন্তু সম্প্রতি শিক্ষক ও স্কুল ম্যানেজিং কমটির মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে এ তথ্য ফাঁস হয়।’
অভিযুক্ত শিক্ষক ফারুক ইসলামের সঙ্গে সুসম্পর্কের বিষয়টি অস্বীকার করেন শাহনাজ বেগম।
খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর শিক্ষক ফারুক ইসলামের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হত্যা মামলার কপি এবং কারাগারে থাকার প্রমাণপত্র চেয়ে দিঘলিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে চিঠি দেওয়া হয়েছ। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পাওয়ার পরই শিক্ষক ফারুক ইসলামকে সামরিক বরখাস্ত করা হবে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হবে। আর হত্যা মামলায় তিনি দুই বছরের অধিক সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, যদি ওই শিক্ষক হত্যা মামলা থেকে খালাস পান তাহেলে অভিযোগ থেকেও অব্যাহতি পাবেন। তথ্য গোপন করায় তার বিরুদ্ধে অন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’