একাত্তরের কলঙ্কের সাক্ষী ‘গণহত্যা জাদুঘর’

1671437254.08.khulna.jpg

ফিচার রিপোর্টার ………..
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শহীদ মাজহারুল ইসলাম কাফনের কাপড় কিনে আনেন। কিন্তু সেই কাফনের কাপড় পরে পরিবার পরিজনের কাছে তার শেষ বিদায় নেওয়া হয়নি।

১৯৭১ সালের ১৪ মে আরও ১৪ জনের সঙ্গে শহীদ হন মাজহারুল ইসলাম। টাঙন লোহার ব্রিজ সংলগ্ন পাড়ে তাদের গণকবর দেওয়া হয়। ২০০১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সেই কাফনের কাপড় ও ব্যবহৃত থালা গণহত্যা জাদুঘরে দিয়ে দেন শহীদের স্ত্রী রাশিদা খাতুন।
‘জোহরা, পারলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সাথে মিশে যেও’- একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনে সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে মাত্র দুই লাইনে স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীনকে এই চিরকুট লিখেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেই বিখ্যাত চিরকুটও চোখে পড়বে জাদুঘরটির প্রথম গ্যালারিতেই।
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু রণাঙ্গনের যুদ্ধ নয়। জাতির গৌরবময় এ অর্জনের প্রতিটি পাতায় পাতায় জড়িয়ে রয়েছে আত্মাহুতি আর নৃশংসতার করুণ কাহিনি, গণহত্যার বর্বর ইতিহাস, কোটি মানুষের আহাজারি, স্বামী হারানো নারীর ত্যাগ, সন্তানহারা মায়ের হাহাকার, সম্ভ্রম হারানো তরুণীর আর্তনাদ, নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়ার পণ।
নিরস্ত্র বাঙালির অকাতরে প্রাণ দানই ছিল বিজয়ের শক্তি। মুক্তিযুদ্ধে বর্বর গণহত্যা আর বাঙালির অকাতরে প্রাণ দেওয়ার সঠিক ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য বিশাল সংগ্রহ নিয়ে খুলনায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’।

সরেজমিনে জাদুঘরটি ঘুরে দেখা যায়, চোখের সামনে জ্বলজ্বলে একাত্তর। জাদুঘরের প্রধান ফটকে চোখে পড়বে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী, মায়ের কোলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, থরে থরে সাজানো ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আলোকচিত্র ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম নির্যাতন, পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগমুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা বিজয়ের মুহূর্ত, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা নিয়ে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের তোলা আলোচিত বিভিন্ন আলোকচিত্র।

রয়েছে গণহত্যায় ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল। নম্বর প্লেটে লেখা রয়েছে যশোর এ-৭৭। যশোরের মনিরামপুরের গিরিন্দ্রনাথ ঘোষের ছেলে অনিল কুমার ঘোষের এই মোটরসাইকেল দিয়ে এলাকায় হত্যাযজ্ঞ চালাত স্থানীয় রাজাকাররা।

প্রথম গ্যালারিতে আরও চোখে পড়বে সেকান্দার আলী সেরনিয়াবাতের স্মৃতি। একাত্তরে তার তিন সন্তান শহীদ হন। পঁচাত্তরে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে সেকান্দারকে তিন হাজার টাকার চেক দেন বঙ্গবন্ধু। শহীদ সন্তানদের শেষ স্মৃতি হিসেবে সেই চেকের টাকা আর তোলেননি সেকান্দার। চেকটি রাখা আছে জাদুঘরের একটি বাক্সে। রয়েছে পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ শীর্ষক চিত্র।

জাদুঘরের আটটি গ্যালারির দুটি নিচতলায়। বাকি ছয়টি গ্যালারি দোতলায়। এর মধ্যে ‘শহীদ গ্যালারি’ সম্পূর্ণ আলাদা। জাদুঘরে ৭ মার্চে ব্যবহৃত একটি মাইক রয়েছে, রয়েছে রেকর্ডও। ৪ ও ৫ নম্বরে থাকা শহীদ বুদ্ধিজীবী গ্যালারিতে রয়েছে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের কলম ও শাড়ি। শাড়িটি পরা অবস্থায় তিনি মারা গিয়েছিলেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুনীর চৌধুরীর পাঞ্জাবি, শহীদ সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের দুটি টাই ও তার ডায়েরি, বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দীন আহমেদের কোট, ইত্তেফাকের বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের পাঞ্জাবি, পায়জামা ও লেখার পাণ্ডুলিপি, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ডায়েরি, ছবি, তার হাতের লেখাও আছে। ফরিদপুরের নগরকান্দা থানার বাগাট গ্রামের গণকবরের মানুষের মাথার খুলি ও হাড় আছে বাঁধাই কাচের ভেতরে।

সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে দোতলার ৬ নম্বর গ্যালারিতে দেখা যাবে রাজাকারদের বিভিন্ন দলিল ও অলংকার। রাজাকারদের ব্যবহৃত ঘুঙুর থেকে জানা গেছে, দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার টাঙ্গন নদের দৌমোহনী ঘাটসংলগ্ন শ্রীমন্তপুরের একটি রাজাকার দল নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষার্থে ঘুঙুর ব্যবহার করত। কোমরে ঘুঙুর থাকলে দলের অন্য সদস্যরা ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বুঝতে পারত এরা রাজাকার।

রয়েছে কুখ্যাত জেনারেল এ কে নিয়াজির গণহত্যার পরিকল্পনার দলিল। এ ছাড়া পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের নির্যাতনের বিভিন্ন অস্ত্রও রয়েছে জাদুঘরে। রয়েছে খুলনার খালিশপুরের প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস নির্যাতনকেন্দ্র ও বধ্যভূমিতে ব্যবহৃত বয়লারটি, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মমতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এই বয়লারে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো বাঙালিদের। পাটকলের বাঙালি শ্রমিক, স্বাধীনতাকামীদের ধরে এনে বেঁধে বয়লারে প্রথমে পা ঢোকানো হতো এবং পা পোড়ানো হলে শরীরের বাকি অংশও বয়লারে ঢোকানো হতো। চিৎকারে প্রকম্পিত হতো পুরো এলাকা, অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দিয়ে পোড়ানো হতো পা থেকে মাথা।

রাজশাহী থেকে এই জাদুঘর দেখতে আসা দর্শনার্থী এবং রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিফা তামান্না রিমি বলেন, যদিও গণহত্যা, গণকবর ও শরণার্থীর ছবি দেখে খুব মন খারাপ লাগছে; তবুও এগুলো দেখার পর আরও ভালো করে বুঝতে পারছি আমাদের দেশ স্বাধীন করতে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমরা বই পড়ে হয়তো এই বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছি বা জানতে পারি, কিন্তু এমন স্বচক্ষে দেখলে সেই বিষয়টি আরও ভালোভাবে অনুভব করা যায়। তখন সত্যিই নিজের দেশের কথা ভেবে, মুক্তিযুদ্ধের কথা ভেবে গর্ব অনুভব হয়।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের শিক্ষার্থী আফরোজা তামান্না বলেন, গণহত্যার পেছনে যে আমাদের এমন নির্মম একটা ইতিহাস আছে, এত মানুষের জীবন দেওয়ার একটা ইতিহাস আছে, তা এখানে না এলে সেভাবে বোঝা যাবে না। এ নিয়ে আলোচনা কম। তবে এটি আমাদের জন্য দুঃখের যে, দেশের জন্য এতো মানুষ আত্মত্যাগ করেছে। আমি ইতিহাসের শিক্ষার্থী, কিছুটা হলেও বিষয়গুলো জানি। তবে অন্যদের আগ্রহ আরও অনেক বেশি। তারা এসে নিজেরাই বলছে যে, আমাদের উচিত এই বিষয়গুলোকে আরও প্রচার করা, সবাইকে জানানো। বিশেষ করে পাকিস্তানিদের নির্মম নির্যাতনকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক ও গবেষণা কর্মকর্তা রিফাত ফারজানা জানান, গণহত্যার বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত, গণহত্যা-নির্যাতনের অনলাইন ও অফলাইন আর্কাইভ গড়ে তোলা, শিশু-কিশোরদের নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রদর্শনীর আয়োজন, প্রতিযোগিতা; প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নিয়ে ‘গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট’ ও ‘শহীদ স্মৃতি’ গ্রন্থমালা প্রকাশ, গণহত্যা-নির্যাতনের জাতীয়, আন্তর্জাতিক সেমিনার ও শহীদ স্মৃতি বক্তৃতার আয়োজন করছে এই জাদুঘর।

তিনি বলেন, সারাদেশে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক তৈরি, নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ে গবেষণা ও কাজের জন্য ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম তৈরি, একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বৈশ্বিক প্রচারণা, নেটওয়ার্কিং ও অ্যাডভোকেসি করাসহ বিশ্বের গণহত্যাসংক্রান্ত নানা সংবাদ নিয়ে জেনোসাইড মিডিয়া ডাইজেস্ট তৈরির কাজ চলছে।

এ বিষয়ে কথা হলে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাংলানিউজকে বলেন, পৃথিবীর গণহত্যাবিষয়ক চিন্তাচর্চার সঙ্গে বাংলাদেশের গণহত্যাবিষয়ক চিন্তাচর্চার মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল, এর সঙ্গে গত শতকের অন্যান্য অঞ্চলে সংঘটিত গণহত্যার মিল ও অমিল রয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের গণহত্যা বৈশ্বিক ইতিহাসেরও অংশ। গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য আমাদের যে লড়াই, তা বেগবান করতে আমরা কাজ করছি।

এ ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন নারকীয় গণহত্যার স্মৃতি যেন মুছে না যায়, সেজন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে স্বাধীনতার ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করাসহ দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪০টি জেলায় গণহত্যা জাদুঘর স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর।

২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনকে সভাপতি করে ১১ সদস্যের জাদুঘর ট্রাস্ট গঠিত হয়। ওই বছরের ১৭ মে খুলনার একটি ভাড়া বাড়িতে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট’ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

এভাবেই যাত্রা শুরু হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘরের। অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে একাত্তরের নির্মম ইতিহাস বুকে নিয়ে সগৌরবে পথ চলছে এই জাদুঘর। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার মহান ব্রত কাঁধে তুলে নিয়েছে নিজ দায়িত্বে।

এই বিষয়ে অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা বা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কিছু লিখতে গেলেও আমাদের উপাদান দরকার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চা যে সীমাবদ্ধ, তার কারণ তথ্যের সীমাবদ্ধতা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উপাদানগুলো আমরা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করিনি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রত্নসম্পদও তো রক্ষা করা যায়নি। গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ৬৪টি জেলায় গণহত্যার ঘটনা, বধ্যভূমি, গণকবর ও টর্চার সেলের একটি জরিপ পরিচালনা করছে। এর মধ্যে অনেক জেলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে ও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা সংরক্ষণ করা হয়নি। গত ৫২ বছরে গ্রামের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষজন যারা ছিল তাদের বেশির ভাগই নেই। স্মৃতির বিস্মৃতি ঘটেছে। তবু আমরা যে তথ্য পেয়েছি, তা-ই নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস এই আর্কাইভ ও জাদুঘর।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top