খুলনার দর্পণ ডেস্ক : খুলনা জেলার দক্ষিণে কয়রা উপজেলা। সেখানে এক সময় নোনা পানিতে তলিয়ে থাকতো। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় সকল গাছপালা মরে যায়। সে সময় এ উপজেলা মরুভূমিতে পরিণত হয়। আর জোয়ারের সময় কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া এবং কয়রা নদীর নোনা পানির সাথে মিলে হতো একাকার। তখন কোনটা বিল, কোনটা রাস্তা এবং কোনটা বাড়ির উঠান কিছুই বোঝা যেত না। এখন নোনা পানির সেই ভূমিতে সোনা ফলছে। উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের উলা গ্রামের মোঃ মোসাররফ হোসেন গাজী তেমনই এক উদাহরণ। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে তিনি তার তিন বিঘা জমিতে বাগদার পোনার নার্সারি করতেন। এ ব্যবসায় তিনি কোনো বছরে লাভবান হতেন আবার কোনো বছর লোকসানের মুখে পড়তেন। বছরজুড়ে তিনি থাকতেন দুশ্চিন্তা আর পাওনা টাকা আদায়ের তাগিদে। চলতি বছরের আষাঢ় মাস হতে তিনি ওই নার্সারিতে মিষ্টি (স্বাদু) পানির মাছের ঘের শুরু করেন। একই সাথে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরামর্শে ঘেরের আইলে সবজি চাষাবাদ করেন। পরে ঘেরে আইলে অসময়ের তরমুজের বীজ বপন করেন। ক’দিন বাদে সেই বীজ থেকে তাজা গাছের উঁকি দিতে দেখে আগ্রহ বাড়ে মোসাররফের। পরিচর্যা শুরু করেন এবং অন্য শাক ও বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষাবাদও করেন। ঘেরের আইলের পাশ দিয়ে পানির ওপরে করে বাঁশ, কুঞ্চি এবং নেট দিয়ে মাচা করে দেন। মাস দেড়েক পর সেই মাচা ভরে যায় সবুজ গাছে আর ফুলে। আর ক’দিন বাদে তরমুজ ঝুলে পড়ে মাচার নিচে। তখন নেটের ব্যাগ দিয়ে প্রতিটি তরমুজ বেঁধে দেন তিনি। অন্যদিকে পানিতে তখন নাইলোটিকা, রুই, কাতলার লাফালাফি শুরু হয়। মন ভরে যায় কৃষকের। আশপাশের এলাকার মানুষরা দেখতে আসে, নোনা ভূমিতে মিষ্টি তরমুজ আর স্বাদু পানির মাছ দেখতে। কয়েকদিন আগে ওই গাছ থেকে ৯৭ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেন তিনি। আরও কিছু বিক্রির আশা করছেন তিনি। একই সাথে ঘেরের মাছ বিক্রি হয়েছে লক্ষাধিক টাকার। আরও দেড় লাখ টাকার মাছ বিক্রির আশা করছেন তিনি।
কৃষক মোঃ মোসাররফ হোসেন গাজী জানান, একসময় আমি বাগদা মাছের নার্সারি করতাম। লাভ হবে কি না। বেড়িবাঁধ ভাঙলো কি না। বাকী টাকা উদ্ধার হবে কি না। এমন অনেক টেনশন হতো। আষাঢ় মাস থেকে একটা বড় ঝুঁকি নেই। আমার মোড় ঘুরে গেছে। কোনো টেনশন নেই। ঘরে বসে, ঘুরে ফিরে আমার ইনকাম বেড়েছে। আমাকে দেখে এখন এলাকার অনেকেই এভাবে স্বাদু পানির মাছ, সবজি চাষাবাদে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট কয়রার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ জাহিদ হোসেন জানান, কয়রা উপজেলার বাগালী ইউনিয়নের উলা গ্রামের মোঃ মোসাররফ হোসেন গাজীসহ স্থানীয় অনেকেই নোনা পানির ঘের করতো। আমাদের পরামর্শে এখন তারা স্বাদু পানির ঘের করছে। একই সাথে ঘেরের আইলে বিভিন্ন ধরনের শাক, সবজির চাষাবাদ করছে। তারা নিজেরা লাভবান হচ্ছে। অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছে। স্থানীয় অনেক ঘের মালিক আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে মিঠা পানির মাছ চাষাবাদ এবং সবজির আবাদ করার জন্য। আমাদের পক্ষ থেকে যত ধরনের সহায়তা রয়েছে আমরা করছি।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ হারুনর রশিদ জানান, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে এ সব এলাকায় মিঠা পানির মাছ নেই। বর্তমানে আমাদের পরামর্শে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সাদা মাছ, সবজি চাষাবাদ শুরু করেছে কৃষকেরা। এই তরমুজের বীজটি আমাদের উদ্ভাবিত। এই বীজ বছরের যেকোনো সময়ে চাষাবাদ করা যায়। বীজ সংরক্ষণ করাও যায়। এ বীজ বপন করে কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। তার একটি জ¦লন্ত উদাহরণ বাগালী ইউনিয়নের উলা গ্রামে।
নোনা ভূমিতে মিঠা ফল, লাভবান কৃষক
