সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি…
পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ থেকে জায়গাটির দূরত্ব মাত্র ৩৫ কি.মি.। ফলে সুনামগঞ্জ জেলায়ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। এ কারণে সুনামগঞ্জের হাওর-বিলে পানি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আগেই বাড়তে শুরু করে। দেখা দেয় বন্যা।
এ ছাড়া সুনামগঞ্জ চেরাপুঞ্জিঘেঁষা হওয়ায় উজান থেকে নেমে আসে পাহাড়ি ঢল। জেলায় বন্যা হওয়ার এটিও একটি কারণ। তবে সুনামগঞ্জে বন্যার পেছনে এ দুটি কারণ ব্যাতীত আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে রাইজিংবিডিকে জানিয়েছেন গবেষকরা।
নদ-নদী আর হাওর-বাওরে ভরা সুনামগঞ্জ। বছরের প্রায় ৭ মাস জলমগ্ন থাকে এই জেলা। এ ছাড়া চেরাপুঞ্জির পানি মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যে এই জেলার তাহিরপুরে নেমে আসে। ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপন্ন হওয়া অনেক ছোট ছোট নদীর পানি সুনামগঞ্জের উপর দিয়ে সুরমা, কুশিয়ারা, চলতি, যাদুকাটা, রক্তি, খাসিয়ামারাসহ জেলার বিভিন্ন নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই পানি মেঘনা হয়ে সাগরে গিয়ে মেশে। কিন্তু বর্তমানে বৃষ্টি বা পাহাড়ি ঢলের পানি নদ-নদীতে প্রবাহিত হলেও সেই পানি দ্রুত নামতে পারে না। ফলে নদীর দু’কূলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
২০২২ সালে এ কারণে ১২২ বছরের ইতিহাসে সুনামগঞ্জে ভয়াবহ বন্যা হয়। শত বছরের মধ্যে এতো মারাত্মক বন্যার মুখোমুখি হননি বলে জানান জেলার অনেকে। সে বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। মারা যায় ১৫ জন। ভয়াবহ বন্যায় নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। জেলার ৫০ হাজার মানুষের ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। ভেসে যায় ঘরের আসবাবপত্র, গোলার ধান, মাছের খামার ও গবাদি পশু।
এমন বন্যার কারণ এবং প্রতিকার খুঁজতে এই প্রতিবেদক কথা বলেন সুনামগঞ্জের হাওর ও নদী গবেষক, হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতা, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নেতা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী এবং স্থানীয়দের সঙ্গে।
সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর রজতকান্তি সোম বলেন, আমরা গত বছর ভয়াবহ বন্যা দেখেছি। আমার জীবনকালে এ রকম বন্যা দেখি নাই। এর দুটো কারণ। এক পাহাড়ি ঢল। দুই আমাদের এই অঞ্চলে বৃষ্টি হয়তো বেড়ে গেছে। আমরা জানি, গ্লোবাল ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে সুনামগঞ্জে কখনও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না, আবার কখনও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হচ্ছে।
উজান থেকে নেমে আসা প্রথম ঢলের সময় পলি মাটি আসে। ফলে নদীর তলদেশ, হাওরের তলদেশ ভরাট হচ্ছে। কিন্তু আমরা এটা মোকাবিলার জন্য কি করছি? প্রয়োজন অনুযায়ী প্রর্যাপ্ত ড্রেজিং হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত সুনামগঞ্জে ফসলহানী বড় একটা ব্যাপার। এই অঞ্চলের মানুষ বোরো ফসলের উপর নির্ভর করে। তাদের ইনস্ট্যান্ট এই রিলিফ দিতে গিয়ে আমরা যে হারে বাঁধ দিচ্ছি, সেই বাঁধ কিন্তু সমাধান নয়। কারণ মাটির বাঁধ যখন ভেঙে যায়, তখন আশেপাশের হাওর ও জলাভূমি ভরে বটম উপরে উঠিয়ে দেয়। বলেন রজতকান্তি সোম।
সমাধান কীভাবে হতে পারে এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তাৎক্ষণিক ঢলের পানির জন্য আমরা ফ্লাড বেরিয়ার ব্যবহার করতে পারি। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি।
সুনামগঞ্জে বন্যার পেছনে খাল দখল, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, হাওরের বুক চিরে সড়ক পথসহ আরও কয়টি বড় কারণকে দায়ি করেছেন হাওর ও নদী গবেষক অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, সুনামগঞ্জের বন্যার কারণ অনেকটা প্রকৃতির ব্যাপার। আরেকটা আমাদের নিজেদের সৃষ্টি। আমাদের উন্নয়ন এমন হচ্ছে ভারসাম্য রক্ষা করছে না। সুনামগঞ্জের খাল যা ছিল তা কিছুই নেই। সব ভরাট হয়ে গেছে। সুনামগঞ্জের ভিতর দিয়ে একটা খাল ছিল, শহরের বড়পাড়া এলাকা দিয়ে একদম মাঝ শহর দিয়ে চলে গেছে। নদী থেকে আসা পানি খালে নেমে যেত। এই খালগুলো ভরাট করে ফেলেছে মানুষ।
চিত্তরঞ্জন তালুকদার আক্ষেপ করে বলেন, অথচ এটা যে বিপদের কারণ হতে পারে চিন্তা করারও কেউ নেই। যে কারণে সুরমা নদীর তলদেশ ভরে যাওয়ায় পাহাড়ি ঢল একটু আসলেই পানিতে সুনামগঞ্জ ভেসে যায়। এই খালগুলো আগে উদ্ধার করা দরকার।
এই গবেষক আরো বলেন, সিলেট-সুনামগঞ্জের আঞ্চলিক মহাসড়কও এ জন্য দায়ী। সড়ক মানুষের প্রয়োজনেই হয়েছে। কিন্তু সেটা অন্যভাবেও করা যেত। সুরমা নদীর পানি প্রবাহিত হয়ে ধনু নদীতে পড়েছে। এই নদীর পূর্ব অংশের পানি সিলেট সুনামগঞ্জ সড়কে আটকা পড়ে। তাহলে পানি যাবে কোন দিকে? একটা মাত্র রাস্তা আছে ডাবরের ব্রিজ দিয়ে পানি পাস হওয়ার। এতো ছোট একটা জায়গা দিয়ে এতো পানি কিভাবে পাস হবে? কিন্তু যখন এই সড়ক ছিল না, উত্তর দিক থেকে পানি এসেছে, সব পানি দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। তাহলে আমরা যখন রাস্তা করলাম এ কথাগুলো কেন ভাবলাম না? এটা সড়ক না হয়ে ফ্লাই ওভার হতে পারত। এতে জীববৈচিত্র্যও রক্ষা করা যেত।
রাইজিংবিডির এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একইভাবে বারবার শীত মৌসুমে হাওর থেকে মাটি উঠিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়। বর্ষায় আবার বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয়। হাওরের বাঁধ ভেঙে তো দিতেই হবে। কারণ হাওরে পানি আটকাতে হবে ফসল রক্ষার জন্য। আবার নৌকা ঢোকার জন্য রাস্তা দিতে হবে। এভাবে প্রতি বছর হাওরে মাটি কাটার কাজ করা যাবে না। অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
কী সেই ব্যবস্থা জানতে চাইলে এই নদী গবেষক বলেন, বাঁধগুলোকে রাবার ডাম্প করেন। ১৮৩টা বাঁধ আছে, প্রতি বছর ৫টা করে রাবার ডাম্প করা হোক। জেলার সব দখল করা খাল উদ্ধার করতে হবে।
সুনামগঞ্জে আগে যেরকম ভূমি ছিল, নদীর নাব্যতা ছিল, হাওরে কোনো বাধা ছিল না তাই উত্তরের পানি এসে বন্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। এখন হাওরে অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে পানি প্রবাহে বাধা তৈরি হচ্ছে। তাই বন্যা হয়। বন্যার পানি নেমে যেতে অনেক সময় লাগে বলে জানান ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায়।
তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা মিঠামইন সড়কে আমাদের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। কারণ ওইদিকে পানি যাচ্ছে না। মিঠামইন ইটনার যেদিকে পানি প্রবাহিত ছিল সেই পথ বন্ধ হওয়াতে সুনামগঞ্জ জেলায় হাওর অঞ্চলের পানি বাড়ছে। এ ছাড়া সুরমা নদীর তলদেশ পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এটা যদি খনন না করা যায় তাহলে অবস্থা আরো খারাপ হবে। আমাদের দাবি হলো- দ্রুত নদী খনন করা এবং আশপাশে যে বড় বড় খাল রয়েছে এগুলা সংস্কার করা।
তবে উজানে যখন অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়, সেই পানি সহজে ফসল রক্ষা বাঁধের উপর দিয়ে সরাসরি নিম্নাঞ্চলে বা সমুদ্র চলে যেতে পারে। শুধু হাওরে রাস্তা নির্মাণের ফলে পানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে দাবি করেন সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার।
তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, আমরা ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক করছি। ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কে সুনামগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে বাঁধগুলো করেছে সেগুলো ডুবন্ত বাঁধ। পরিবেশের কথা চিন্তা করেই এটা করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে যেনো পানি ডুবন্ত বাঁধের উপর দিয়ে সরাসরি নিম্নাঞ্চলে চলে যেতে পারে বা সমুদ্রে চলে যেতে পারে এ জন্যই এই বাঁধ। তবে বর্তমানে অনেক জায়গায় কিছু রাস্তা নির্মাণের ফলে পানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এগুলো চিহ্নিত করা উচিত বলে মনে করেন এই প্রকৌশলী।