ডেস্ক রিপোর্ট: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার চার নেতার- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যখন শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে বন্দি ছিলেন, তখন দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেছেন তারা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই নেতাদের ভূমিকা যথাযথভাবে মূল্যায়িত এবং তারা ইতিহাসে তেমনভাবে আলোচিত হননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে শেখ মুজিব ‘কোনোদিন জানতে চান নাই যে এই নয় মাস তারা (প্রবাসী সরকার) কী করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন।’
শেখ মুজিব তার শাসনামলের সাড়ে তিন বছরে ‘মুজিবনগরের ওই জায়গাটা কখনও দেখতেও যাননি’ এবং ‘কলকাতার আট নম্বর থিয়েটার রোডে ছিল বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর। সেখানে সৈয়দ নজরুল ইসয়াম, তাজউদ্দীন থাকতেন। তিনি যখন কলকাতায় গিয়েছিলেন, সেই বাড়িটিও তিনি কখনও দেখতে যান নাই। অর্থাৎ এই প্রবাসী সরকারের ব্যাপারটা শেখ মুজিব কখন অনুমোদন করেন নাই।’
শেখ মুজিবুর রহমানের এইসব পদক্ষেপ থেকে ‘বোঝা যায় যে তিনি এই অপশনটা পছন্দ করেন নাই।’
আহমদ আরও বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে আওয়ামী লীগের এই চার নেতা ‘ধীরে ধীরে আড়ালে চলে গেলেন। আমরা দেখলাম, চার নেতার মাঝে একটা সময় তাজউদ্দীন আহমেদ ব্রাত্য হয়ে গেলেন।’
১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন আহমেদকে ‘বিদায় করে দেওয়া হল। বাকি তিনজন শেখ মুজিবের খুব অনুগত ছিলেন, সেই কারণে টিকে গেলেন,’ বলছিলেন এই বিশ্লেষক।
চার নেতার প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের এ ধরনের উদাসীনতা বা অবহেলার বিষয়টি উঠে আসে তাজউদ্দীন আহমেদের কন্যা শারমিন আহমেদের বক্তব্যেও।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তান কারাগারে অন্তরীণ। যুদ্ধের সাথে ওনার সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না, উনি তো আত্মসমর্পণ করে চলে গেলেন। যদিও ওনার সিম্বলটা মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক কাজে লেগেছিলো। ফলে লিডারশিপের দায়িত্ব পড়লো তাজউদ্দীন আহমেদের কাঁধে।’
‘তারা বিপ্লবী চেতনা ধারণ করে যে দক্ষতার সাথে সরকার গঠন করলেন…কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধের কথা একবারও জানতে চাইলেন না,’ বলছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের মেয়ে শারমীন আহমেদ।
তার মতে, শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকাকালীন তিনি চার নেতাকে এক পাশে সরিয়ে রেখেছিলেন। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে দল হিসাবে আওয়ামী লীগও তাদেরকে অবমূল্যায়ন করেছে।
লেখক মহিউদ্দিন আহমদও বলেন, বরাবরই ‘আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবময় ছিল, এর বাইরে আর কিছু চিন্তা করতো না। তাই তারা এই চার নেতাকে নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায়নি। তাদেরকে নিয়ে আওয়ামী লীগের মাঝে কখনোই (‘৭৫ পরবর্তী সময়েও) কোনও উচ্ছ্বাস-আবেগ দেখা যায়নি।’
যেসব কারণে অবমূল্যায়নের প্রসঙ্গ আসে
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন যে, বাংলাদেশ নির্মাণে চার নেতা যে একেকটা স্তম্ভ ছিল, তাদের যে অবদান ছিল, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরেও সরকারি বয়ানে এরকম স্বীকৃতি ছিল না। আওয়ামী তাদেরকে দল ও সরকার হিসাবে ওই মর্যাদা দেয়নি।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা একসময় ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ শব্দটি বলে ‘খুব বিপদে পড়েছিলেন’ উল্লেখ করে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন ‘প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যারা ছিলেন, শেখ মুজিবসহ সবাইকেই যদি আমরা ফাউন্ডিং ফাদার ধরে নিই, তাহলে সবাইকেই তো সেই যথাযথ মর্যাদা দিতে হয়।’
ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোন একক ব্যক্তির কারণে হয় নাই’ বলে মন্তব্য করার পর আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ উদাহরণ হিসাবে বলেন, ‘আমাদের যে কারেন্সি নোট ছাপা হয়, প্রতিটাতেই একজনের ছবি। একেকটাতে একেকজনের ছবি থাকলে তো কোনও সমস্যা ছিল না।’
তার মতে, স্থাপনা বা টাকায় নাম দেওয়াটা বড় কথা না। ‘কথা হচ্ছে, ইতিহাসের যে বয়ান তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ, সেখানে শেখ হাসিনা একটা কথা বারবার বলতেন যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা দিয়েছেন। তিনিই যদি স্বাধীনতা দেন, তাহলে অন্যরা কী করেছে?’
‘অথচ বয়ানটা এমন হতে পারতো যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন হয়েছিলো, সেই আন্দোলনের নেতা ছিলেন শেখ মুজিব, কিন্তু সেখানে আরও নেতা ছিলেন – এটি একটি যুথবদ্ধ প্রচেষ্টা।’
তিনি আরও বলেন যে আওয়ামী লীগের ভাষ্যে শেখ মুজিব ছাড়া কেউ নাই।
‘এটা অনেকটা এরকম যে তার কোনো শরিক নাই। তিনিই সার্বভৌম। এটাও এক ধরনের ফ্যাসিস্ট চিন্তা।’
তাজউদ্দীন আহমেদের পরিবারের সদস্যরা বরাবরই সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার কথা বলেছেন।
মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের মেয়ে শারমীন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘শুধু নাম প্রতিষ্ঠিত করে না; প্রত্যেকের জীবনী, আলাদাভাবে তাদের অবদান পাঠ্যসূচির সর্বস্তরে অন্তর্ভুক্ত করা’ যেতে পারতো।
অথচ তাদের কাহিনীগুলো ‘পাঠ্যসূচি বা ন্যাশনাল ডিসকাশন’, কোথাও নাই। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে জেল হত্যা দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন।
‘৩ নভেম্বর, তাদেরকে বিনা বিচারে জেলে হত্যা করা হল। সেটিকে রাষ্ট্রীয় দিবস হিসাবে পালন করতে হবে। সেদিন সরকারি ছুটির কোনও দরকার নাই, কালো শাড়ি পরার দরকার নাই। এটিকে জাস্ট রাষ্ট্রীয় দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া। তাদের নিয়ে আলোচনা করা দরকার।’
‘নয়তো শিক্ষার্থীরা সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে না’ উল্লেখ করে তিনি ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষার ব্যাপারে বলেন, ‘সেই সমীক্ষায় মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করা হল, চার জাতীয় নেতা কে? শিক্ষার্থীরা বললো– খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান।’
কয়েক বছর আগে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাজপুত্র সোহেল তাজও এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা জানি যে ১২ বছর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না, যারা ক্ষমতায় ছিল তারা হয়ত চায়নি, কিন্তু বিগত ১২ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। জেল হত্যা দিবস এখনও পর্যন্ত কেন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হল না – আমার আসলে তা বোধগম্য হয় না।’