পলিতে ভরাট খুলনার ৭৫ স্লুইসগেট, বর্ষায় ডুবে গ্রামীণ সড়ক

taka-1710005478-1.jpg

নিজস্ব প্রতিবেদক: উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকা সুরক্ষায় কয়েক দশক আগে নির্মিত হয় বেড়িবাঁধ। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের একাংশ, গুটুদিয়া ও রংপুর ইউনিয়ন ঘেঁষে গেছে বাঁধের ২৮/১ পোল্ডারটি। ২৩ দশমিক ২৮ কিলোমিটার বাঁধে স্লুইসগেট রয়েছে ৯টি। তবে এর ৭টিই দীর্ঘদিন ধরে অকেজো। পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে মুখ। ফলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ক্ষতির শিকার হতে হয় মাছচাষি ও কৃষককে। একই অবস্থা উপজেলার আরও ৯টি পোল্ডারে। সব মিলিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্মিত ১০১টি স্লুইসগেটের মধ্যে ৭৫টিই কোনো কাজে আসছে না। এ নিয়ে বহুবার আবেদন-নিবেদন করেও ফল পাননি এলাকাবাসী।

এক সময় নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন ডুমুরিয়া গ্রামের আশিস মণ্ডল। এখন নদী-খাল না থাকায় বদলেছেন পেশা। ক্ষুদ্র ব্যবসা করে ৬ সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। আশিস বললেন, গত শতকের ৮০-এর দশকেও স্লুইসগেটগুলো চালু ছিল। ফলে জোয়ার-ভাটার সময় জেলেরা পাল্লা দিয়ে মাছ ধরতেন। নদীতে পালতোলা নৌকা, লঞ্চ-স্টিমার চলত। এখন তা অতীতের গল্প মনে হয়। বেশির ভাগ জেলেই তাঁর মতো পরিণতি বরণ করেছেন।
বর্ষার পানি নামতে না পারায় প্রতিবছর ডুমুরিয়া সদর, রংপুর, গুটুদিয়া, মাগুরখালী, আটলিয়া, ধামালিয়া, রঘুনাথপুর, খর্নিয়া, রুদাঘরার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়। ফলে ধানক্ষেত, মাছের খামার, পুকুরের মাছ, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর, সবজি ক্ষেত ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয় বলে জানান রংপুর গ্রামের কৃষক প্রসেনজিৎ মণ্ডল। তিনি বলেন, এ সময় গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় তাদের। অন্য জায়গায় আশ্রয় খুঁজতে হয়। আর শুকনো মৌসুমে তারা ভোগেন পানি সংকটে।

একই গ্রামের স্কুলশিক্ষক পরিতোষ মণ্ডলের কথায়, বর্ষায় গ্রামীণ সড়ক ডুবে গেলে নিম্নাঞ্চলের মানুষকে ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। উপদ্রব বাড়ে বিষধর সাপের। এ সময় শিশুরা পড়ে বিপাকে। তাদের বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ হয়ে যায়।
বেড়িবাঁধের ১৭/১ পোল্ডারটি মাগুরখালী ও আটলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দাদের জন্য তৈরি। ৩০ দশমিক ১৮ কিলোমিটার অংশে স্থাপিত ১১টি স্লুইসগেটের মধ্যে ৯টি দীর্ঘদিন ধরে কোনো কাজেই আসছে না। ফলে আশপাশের জমি দখল করে নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা।

মাগুরখালীর গজালিয়া গ্রামের কৃষক নিমাই মণ্ডলের ভাষ্য, চিংড়ি ঘের মালিকরা নদী-খাল দখল করে অপরিকল্পিতভাবে মাছ চাষ করছেন। পাউবোর বেড়িবাঁধ ও স্লুইসগেটের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে অবৈধভাবে মাছের খামার, ধান ও সবজির আবাদ করছেন অনেকে। এ কারণে সংকুচিত হয়ে পড়ছে বেড়িবাঁধ। এ জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করেন তিনি।

আটলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান প্রতাপ কুমার রায় বলেন, উপজেলার ১০টি পোল্ডারে প্রায় ৭৫টি স্লুইসগেট কোনো কাজেই আসছে না। এগুলোর সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। জলাবদ্ধতা নিরাসনের জন্য পরিকল্পিত নদী ও খাল খননের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতি বর্ষা মৌসুমে বিপুল পরিমাণ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। জলাবদ্ধতার কারণে কোটি কোটি টাকার সম্পদ হারাতে হয়।

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আমান উল্লাহ আমানের ভাষ্য, এ সংকটের শুরু ১৯৯৬ সালের দিকে। ওই সময় থেকে উপজেলার ভদ্রা, শালতা, থুকড়া-হামকুড়া, হরি নদী, বুড়িভদ্রা নদী ও খালসংলগ্ন স্লুইসগেটগুলোতে অস্বাভাবিক হারে পলি ঢুকতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে বাঁধের ভেতর নদী-খাল ভরাট হয়ে পড়ে। এখন সব জায়গার জমি দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত প্রভাবশালীরা। তাদের ছত্রছায়ায় এক শ্রেণির মানুষ বেড়িবাঁধ কেটে চিংড়ি চাষ করছেন। পানি নিষ্কাশনের সব পথ এখন বন্ধ।
প্রতি বর্ষায় জলাবদ্ধতার কারণে ক্ষেত ডুবে কৃষকের বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে জানান উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্মকর্তা কৃষিবিদ ইনসাদ ইবনে আমিন। তবে কী পরিমাণ জমির ফসল নষ্ট হয়, এ তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে এর পরিমাণ আনুমানিক কয়েক কোটি টাকা।

মৎস্য কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিকের ভাষ্য, উপজেলার ২২ হাজার ১৮৪ হেক্টর জমিতে মাছের চাষ হয়। বর্ষায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অন্তত ৫ হাজার হেক্টর জমির মাছ চাষের ক্ষতি হয়। গড়ে বছরে ৫০ কোটি টাকার মাছ ভেসে যায়।
এ দুই কর্মকর্তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী-খাল খননের জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। এদিকে পাউবোর উপবিভাগীয় সহকারী প্রকৌশলী মো. হাসনাতুজ্জামান বলেন, চাষাবাদ, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় জনসাধারণকে রক্ষায় ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে স্লুইসগেট নির্মাণ শুরু হয়, যা পর্যায়ক্রমে চলে আসছে। বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ডুমুরিয়ায় নানা সময়ে ১০টি পোল্ডারে ৩৫ ফুট চওড়া বাঁধ নির্মিত হয়। মোট ৩৬৬ কিলোমিটার বাঁধে স্লুইসগেট রয়েছে ১০১টি।

খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহমান তাজকিয়া এ বিষয়ে বলেন, পলি পড়ে নদী-খাল ভরাট হচ্ছে। একই সঙ্গে স্লুইসগেটে ফটকও নষ্ট হচ্ছে। নদী-খাল খনন ও স্লুইসগেটগুলো সংস্কারে সরকারের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য তাঁর কাছে পাওয়া যায়নি। অর্থ বরাদ্দ পেলেই পাউবোর জমি উদ্ধারে অভিযানের আশ্বাস দেন তিনি।

Share this post

scroll to top