খুলনার দর্পণ ডেস্ক : লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটছে বাজার। যেন লাগাম টানার কেউ নেই। খোড়া অজুহাতে এক রাতেই পিঁয়াজের কেজিতে বেড়েছে ৮০ টাকা। বাজারগুলোতে পিঁয়াজের পর্যাপ্ত যোগান থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাড়ানো হয়েছে পিঁয়াজের দাম। আর এ জন্য বাজার মনিটরিং ব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থা এবং ব্যবসায়ীদের অসৎ উদ্দেশ্যকে দায়ি করছেন ক্রেতারা।
বৃহস্পতিবার খুলনার অধিকাংশ খোলা বাজারে পিঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০ থেকে ১১৫ টাকা কেজি দরে। শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনেও ছিল প্রায় একই দাম। কিন্তু সকাল হতেই বাজারে পিঁয়াজের দাম উঠলো ১৬০ থেকে ২০০ টাকা প্রতি কেজি। সন্ধ্যের পর থেকে বাড়ল আরেক দফা। সন্ধ্যের পর প্রতি কেজি পিঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা দরে। এটি চিত্রটি খুলনা মহানগরীর মধ্যের হলেও এমন চিত্র খুলনা বিভাগের সবকটি জেলায়। গতকাল খুলনার বড়বাজার এলাকার ব্যবসায়ী তুষার শীল জানান, বুধবার আমি ভারতে ছিলাম। ওই দিন ওখানে আমি পিঁয়াজ কিনেছিলাম ৩০ টাকা কেজি দরে। ওখানে অনেক ভালো মানের পিঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা কেজি দরে। দেশে এসে আজ সকালে পিঁয়াজ কিনতে গিয়ে দেখলাম ৭ গুণ বেশি দাম। পিঁয়াজ যা আসছে, আর যা আছে তাতে দাম বাড়ার কথা না। বাড়ছে সিন্ডিকেটের জন্য। খুলনার বড় বাজার কাঁচা ও পাকা মালের আড়তদার মোঃ নাসির উদ্দন জানান, ব্যবসায়ীদের কারসারি। এ জন্য বাজার মনিটরিং ব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থাই দায়ি এবং ব্যবসায়ীদের অসৎ উদ্যেশ্য।
মোংলা, বেনাপোল ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, এক রাতের ব্যবধ্যানে মোংলায় পিঁয়াজের কেজি বেড়েছে ১০০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত। যদিও এ পিঁয়াজ ব্যবসায়ীদের কেনা রয়েছে দাম বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেটের কৃত্রিম সংকটের আগেই। নানা অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা আগের দামে কেনা পিঁয়াজ তারা যে যার মতো করে ১১০ টাকার জায়গায় ১৩০, ১৪০, ১৫০, ১৬০, ১৭০ ও ১৮০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। শনিবার সকালে হঠাৎ করে পিঁয়াজের দাম বেড়েছে মোংলার বাজারে। শুক্রবার যে পিঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকায়, সেই পিঁয়াজ রাতের ব্যবধানে শনিবার সকালে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ১৮০ টাকা পর্যন্ত। শনিবার সকালে বাজারে এসে পিঁয়াজের দাম শুনে চোখ যেন মাথায় উঠে গেছে ক্রেতাদের। বাড়তি দাম শুনে কেউ পিঁয়াজ না নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন, আবার কেউ সাধ্যমত স্বল্প পরিমাণ পিঁয়াজ কিনে বাড়ি ফিরছেন। ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ, দাম দর নিয়ে বাকবিত-াও ঘটছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে। ক্রেতারা বলছেন, এখন নতুন পিঁয়াজ উঠছে ও উঠবে, তাহলে দাম বাড়বে কেন?
দিমজুর আলী আকবর বলেন, ১১০ টাকার পিঁয়াজ এখন ১৫০/১৬০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমরা গরিব মানুষ কিভাবে এতো বেশি দামে পিঁয়াজ কিনে খাবো। অন্যান্য মালের দামও বেশি, আমাদের পরিবার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
বিক্রেতা মোঃ সেলিম বলেন, শুক্রবার খুলনার মোকামে খোঁজ নিলে মহাজনেরা বলেছেন পিঁয়াজের দাম কেজিতে ৪০/৫০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। মহাজনেরা আমাদেরকে বলেছেন ভারত থেকে নাকি পিঁয়াজ আসা বন্ধ রয়েছে। সেই কারণে দাম বেড়েছে। দাম বাড়ায় গতকাল শুক্রবার খুলনা থেকে মোংলায় কোনো পিঁয়াজ আসেনি। ফলে বাজারেও পিঁয়াজ কম, তাই দোকানদার ও ব্যবসায়ীরা আগের পিঁয়াজই ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।
ভারত পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় যশোরের বেনাপোলে দুই দিনের ব্যবধানে বাজারে পিঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫০ টাকা। বর্তমানে দেশি পিঁয়াজ ১৮০ এবং ভারতীয় পিঁয়াজ ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছে বিপাকে। গত দুইদিন আগে ভারতীয় প্রতি কেজি পিঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল ৮০-৯০ এবং দেশি ১০০-১১০ টাকা কেজি দরে।
এদিকে কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে প্রতি মেট্রিক টন পেঁয়াজের এলসি মূল্য ছিল ৮০০ ডলার। এই মূল্যে গত এক মাস ভারত থেকে সাড়ে ৫শ মেট্রিক টন পিঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। যার সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর ৫৯ মেট্রিক টন পিঁয়াজ রূপালী এন্টারপ্রাইজ নামের একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আমদানি করে। বৃহস্পতিবার এক পত্রের মাধ্যমে ভারত সরকার সে দেশে পিঁয়াজ সংকট দেখিয়ে আগামী ৩১ মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন।
শনিবার সকালে বেনাপোল উদ্ভিদ সংগনিরোধ অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত এক মাসে ভারত থেকে সাড়ে ৫শ মেট্রিক টন পিঁয়াজ আমদানি হয়েছে। যার মধ্যে সর্বশেষ ৫ ডিসেম্বর ৩০ মেট্রিক টন পিঁয়াজ আমদানি করেছে রূপালী এন্টারপ্রাইজের মালিক মিন্নু মিয়া।
বেনাপোল বাজারে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার পাইকারি বাজারে প্রতি মণ পিঁয়াজ বিক্রি হয়েছে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ২০০ টাকায়। কিন্তু গত দুই দিন ধরে পাইকারি বাজারের দাম গিয়ে ঠেকেছে পাঁচ হাজার ২০০ থেকে ৫ হাজার ৬০০ টাকায়। পিঁয়াজের বাজার লাগামহীন বেড়ে যাওয়ায় হতাশ ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা।
বেনাপোল চেকপোস্ট উদ্ভিদ সংগনিরোধে উপ-সহকারী কর্মকর্তা হেমন্ত কুমার সরকার জানান, ভারত থেকে পিঁয়াজ আমদানির ধীরগতির কারণে পিঁয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ। গত এক মাসে ভারত থেকে সাড়ে ৫শ মেট্রিক টন পিঁয়াজ আমদানি হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় জমিতে পিঁয়াজ রোপণ শুরু হয়েছে। ওই পিঁয়াজ বাজারে আসতে কমপক্ষে আরও দুই মাস সময় লাগবে। নতুন পিঁয়াজ বাজারে এলেই দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর বড় বাজারে শুক্রবার ভারতীয় পিঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০/৮০ টাকা। রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পর রাত পার না পেরোতেই শনিবার পিঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা। অনুরূপ দেশি পিঁয়াজ শুক্রবারে বিক্রি হয়েছিল ১০০ টাকা। শনিবার তা বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। অস্বাভাবিক এই দাম বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ ক্রেতারা।
ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নওশাদ দেলওয়ার রাজু জানান, ‘বাজারে পিঁয়াজের ঘাটতি নেই। এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ বুঝে দাম বাড়াচ্ছে। প্রশাসনের কাছে আহবান করি, দ্রুত অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়ার পরই দেশের বাজারে হু হু করে বাড়ছে পিঁয়াজের দাম। এর প্রভাব পড়েছে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটেও। একদিনের ব্যবধানে দেশি ও ভারতীয় পিঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। যার ফলে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ক্রেতারা। সময়ের সাথে সাথে দাম আরও বাড়ছে। তবে বাগেরহাট জেলা প্রশাসন বলছে পিঁয়াজের বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। সেই সাথে অভিযানও চালানো হবে।
বাগেরহাট শহরের কাঁচা বাজারের খুচরা বিক্রেতা ছত্তার শেখ বলেন, পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের খবরে গতকাল রাত থেকে পিঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে গতকালও দেশি পিঁয়াজের দাম ছিল ১শ ২০ টাকা যেটা বর্তমানে ২শ ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ভারতীয় পিঁয়াজের দাম ছিল ১শ টাকা যেটা বর্তমানে ২শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে কেজি প্রতি ১শ টাকা বেড়েছে পিঁয়াজের দাম। এছাড়া বাজারে দেশি পিঁয়াজ পাওয়াই যাচ্ছে না।
শহরের রিক্সা চালক সরোয়ার শেখ বলেন, সারাদিন রিক্সা চালিয়ে ৫ থেকে ৬শ টাকা ইনকাম করি। সেখানে ২শ টাকা যদি পিঁয়াজের পেছনে ব্যয় করতে হয়, তাহলে অন্যান্য বাজার সদাই কিনবো কি করে। আমরা বাঁচবো কি করে। ছেলে-মেয়েদের মুখে খাবার তো তুলে দিতে হবে। আমাদের তো বাঁচতে হবে।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাঃ খালিদ হোসেন বলেন, হঠাৎ করে সারাদেশে পিঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা বাজার মনিটরিং করছি। আগামীকাল থেকে বাজারে অভিযান চালানো হবে।
লাগামহীন পিঁয়াজের বাজার এক রাতেই দাম দ্বিগুণ
