মরিয়ম মান্নানের মায়ের আত্মগোপনের নাটক, সারাদেশ তোলপাড়

1672471580.1.jpg

ব্যুরো এডিটর ……
রাত পোহালেই ২০২৩ সাল। ঘটনাবহুল বিদায়ী ২০২২ -এ খুলনায় ঘটে গেছে নানা আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা।

এমনকি কয়েকটি ঘটনা দেশবাসীকেও নাড়াও দিয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো নিখোঁজ মা রহিমা বেগমকে খুঁজে পেতে খুলনার তরুণী মরিয়ম মান্নানের কান্না-আহাজারি। ঘটনাটি প্রায় একমাস ধরে আবেগের জোয়ার এনেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই জোয়ারের প্রভাবে প্লাবিত হয়েছিল গণমাধ্যমের কিছু অংশও।

গুম-খুন নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণায় মরিয়ম মান্নানের আবেগী কান্না যোগ হয়ে ভিন্ন মাত্র আনে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে বাধ্য হন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পরে বের হয় গোটা ঘটনাই ছিলো মরিময় মান্নানের সাজানো নাটক। এ নাটক ছিল প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর চেষ্টামাত্র।

যেভাবে নাটকের শুরু:

২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপ থেকে পানি আনতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি রহিমা বেগম। ওই রাতেই রহিমা বেগমের ছেলে দৌলতপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। রহিমা বেগমের ছেলেমেয়েরা মায়ের সন্ধান চেয়ে এলাকায় পোস্টার লাগান, ঢাকা ও খুলনায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন করেন তারা।

মেয়ে মরিয়মের ফেসবুকে মায়ের সন্ধান চেয়ে বিভিন্ন পোস্ট দেন। ঘটনাটি ফেসবুকে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়। মায়ের সন্ধানের দাবিতে আয়োজিত এক কর্মসূচিতে মরিয়ম মান্নানের কান্নার ছবি দেখে তার পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন অনেকে।

২৮ আগস্ট রহিমা বেগমের আরেক মেয়ে আদুরী আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে খুলনার দৌলতপুর থানায় মাকে অপহরণের অভিযোগ তুলে মামলা করেন।

প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর চেষ্টা:

রহিমাকাণ্ডে কথিত অপহরণের নাটক সাজিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মিথ্যা মামলায় আসামিদের জেল খাটানো হয়েছে। দৌলতপুর থানায় জিডি ও পরে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে করা মামলায় ৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ও র‍্যাব।

গ্রেফতাররা হলেন- খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশল কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী মো. গোলাম কিবরিয়া, নিখোঁজের দ্বিতীয় স্বামী হেলাল হাওলাদার, দৌলতপুর মহেশ্বরপশা বণিকপাড়া এলাকার মহিউদ্দিন, পলাশ, জুয়েল ও হেলাল শরীফ। দীর্ঘদিন জেল খেটে নিরাপরাধ এসব মানুষ এখনও মামলার ঘানি টানছেন।

প্রতিপক্ষ কাউকে ফাঁসানো মরিয়ম মান্নানের পুরনো অভ্যাস, এমনকি তার এই জাল থেকে সৎ পিতাও রেহাই পায়নি বলে অভিযোগ করেন তার প্রতিবেশিরা।

মরিয়ম মান্নানের বক্তব্যে বিভ্রান্ত ছিল সবাই:

বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমকে বিভ্রান্ত করেছে এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড রহিমার কন্যা মরিয়ম মান্নানের ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাস।

রহিমা বেগম যখন নিখোঁজ হওয়ায় গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- সব জায়গায় তার ছয় ছেলে-মেয়ের মধ্যে সক্রিয় উপস্থিতি ছিল মরিয়মের। তার কান্নার মধ্যে ছিল রহস্য, কথার ভেতর লুকোচুরি। কখনোই তিনি গণমাধ্যমকে সঠিক তথ্য দেননি। সংবাদকর্মীদের সঙ্গে তার রূঢ় আচরণের অভিযোগও রয়েছে।

পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধেও এ তরুণী নানা অভিযোগ তুলেছেন। এরই মধ্যে ময়মনসিংহে উদ্ধার করা একটি মরদেহকে নিজের মায়ের বলে দাবি করেন মরিয়ম মান্নান।

ডিএনএ টেস্ট ছাড়া মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে পুলিশ জানালেও তিনি দাবি করেন, অর্ধগলিত যে মরদেহ পাওয়া গেছে, সেটাই তার মায়ের। মায়ের শরীর চিনতে কোনো প্রমাণ লাগে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মূল রহস্য উদঘাটন:

খুলনার মহেশ্বরপাশায় নিখোঁজ রহিমা বেগমকে অক্ষত অবস্থায় ২৪ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রাম থেকে উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। উদ্ধারের আগে দিব্যি দৈয়দপুরে কুদ্দুসের বাড়িতে রীতিমতো গল্পরত অবস্থায় থাকলেও পুলিশ দেখা মাত্র কেন চুপ হলে গেলেন রহিমা। উদ্ধারের পরপরই পাল্টাতে থাকে দৃশ্যপট।

পুলিশেরও ধারণা জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মা রহিমার সঙ্গে মিলে মরিয়মসহ তার অন্য সন্তানরা অপহরণের নাটক সাজান। অভিযোগ, রহিমা আত্মগোপনে যাওয়ার পর অজ্ঞাতপরিচয়ের যে কোনো নারীর মরদেহকে মায়ের বলে দাবি করার পরিকল্পনাও সাজিয়ে রেখেছিলেন তার মেয়েরা।

এর ফলে, প্রথম দিকে যারা মরিয়মের মায়ের খোঁজে আন্দোলনের পোস্টগুলো লাইক-কমেন্টে-শেয়ার করে ভার্চুয়ালি সঙ্গে ছিলেন; তারাই তার বিরুদ্ধে লিখা শুরু করেন। দেশবাসীর কাছে এটি স্পষ্ট হয় যে, রহিমা বেগম অপহরণ হয়নি। এটি ছিলো ষড়যন্ত্রমূলক একটি সাজানো নাটক।

স্থানীয়রা বলছেন, রহিমাকাণ্ডে সম্পূর্ণটাই মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমুলক নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে একটি পক্ষকে ফাঁসানোর সব চেষ্টা করা হয়েছে। প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করতে গুম অপহরণের কথা বলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অপচেষ্টা হয়েছে। অপহরণের পর মরিয়ম মান্নান গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির আর হৃদয় বিদারক কান্না দেশের মানুষের সহানুভূতি কুড়ালেও রহিমা উদ্ধারের পর প্রকৃত ঘটনা সামনে আসায় মরিয়ম মান্নানকে নাটকবাজ আখ্যায়িত করে তাকে আইনের আওতায় আনার দাবি তোলা হয়।

মরিয়ম মান্নানকে তুলোধোনা:

প্রতিবেশিরা জানান, মরিয়ম মান্নান একজন নারীবাদী নেত্রী। তিনি একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। ২০১২ সালে তার বাবা আব্দুল মান্নানের মৃত্যু হয়। এ সময় এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি। পাস করার পরে চলে আসেন ঢাকায়। শুরু হয় উশৃঙ্খল জীবন-যাপন। ঢাকা আসার বেশ কিছুদিন পর তিনি বিয়ে করেন এক ডেন্টাল চিকিৎসককে। পরে তাকে ছেড়ে আরেকটি বিয়ে করেন বরিশাল জেলায়। তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আপনজনরা তেমন কিছুই জানেন না। ঢাকার অভিজাত একটি এলাকায় দুই-তিনটি নারী হোস্টেল খুলে ব্যবসা করছেন। সেখানে অবাধে নারী-পুরুষের যাতায়াত রয়েছে। ফেসবুকে মরিয়মের কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়েছে, যা দেখে সূত্রটির দাবির সঙ্গে মিলে যায়।

চার বছর আগেও কোটা আন্দোলনে পুলিশি হেফাজতে নিজের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে লাইমলাইট পেয়েছিলেন মরিয়ম মান্নান। শারীরিকভাবে তাকে হেনস্তা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ভাইরাল হন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার পোস্ট ছবি ভিডিও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করে। সে সময় তেজগাঁও কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন মরিয়ম মান্নান।

রহিমা বেগম যখন নিখোঁজ হন; গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সব জায়গায় তার ছয় ছেলে-মেয়ের মধ্যে সক্রিয় উপস্থিতি ছিল মরিয়মের। তার কান্নার মধ্যে ছিল রহস্য, কথার ভেতর লুকোচুরি। কখনোই তিনি গণমাধ্যমকে সঠিক তথ্য দেননি। সংবাদকর্মীদের সঙ্গে তার রূঢ় আচরণের অভিযোগও রয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধেও এ তরুণী নানা অভিযোগ তুলেছেন।

মাকে ফিরে পাওয়ার পর বেশ কয়েকটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন মেয়ে মরিয়ম মান্নান। যেখানে তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশের পাশাপাশি সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন যারা এতদিন তার পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে তার ভিন্ন চিত্র। মাকে এতদিন পর ফিরে পাওয়ায় যেখানে সবাই সাধুবাদ জানানোর কথা, সেখানে তার পেজে দেওয়া স্ট্যাটাসগুলোতে হাসির প্রতিক্রিয়ার ছড়াছড়ি। এমনকি মন্তব্যের ঘরেও চলছে তীব্র সমালোচনা।

মায়ের অন্তর্ধানের ঘটনা নিয়ে আলোচনায় আসা মরিয়ম মান্নান ছিলেন তখন টক অব দ্য কান্ট্রি। মা নিখোঁজ হওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে অসংখ্য মানুষ তার পাশে থেকে সহানুভূতি জানিয়েছিলেন- তারাই এখন তাকে তুলোধোনা করছেন। জনপ্রিয় টিভি নাটক ব্যাচেলর পয়েন্টের ‘রোকেয়া’ চরিত্রের সঙ্গে তার মিল রয়েছে বলেও ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন অনেকে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top