অভিভাবকদের নাভিশ্বাস ২৫ টাকার খাতা ৩৫ টাকা, ২৫শ টাকার টেস্ট পেপার সাড়ে ৪ হাজার

pen-cover-20221220183146.webp

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক…

বিশ্ববাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দেশের শিক্ষা খাতেও। অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে সব ধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম। গত তিন মাসে কাগজ, কলম, খাতা, সহায়ক বইসহ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এসব সামগ্রীর বিক্রি কমেছে খুচরা দোকানে। অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের বেড়েছে খরচ। বাড়তি খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। সবচেয়ে বড় সংকট কাগজের। নতুন বছরের শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর জন্য যা একটি বড় ধাক্কা।
রাজধানী ঢাকার নীলক্ষেত, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া যায়।
মিরপুর-১ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের বাগদাদ মার্কেটের নিচতলায় ও পার্শ্ববর্তী মসজিদ মার্কেটে বই-খাতা বিক্রির একাধিক দোকান রয়েছে। অনেকগুলো সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-অভিভাবক এখান থেকে শিক্ষা উপকরণ কেনেন। অনেক সময় দূর-দূরান্ত থেকেও ক্রেতা আসেন তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে।

এখানকার রাফী বুক অ্যান্ড স্টেশনারির স্বত্বাধিকারী মো. রাশেদ জাগো নিউজকে বলেন, কাগজের তৈরি সব পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। বছরের শেষে অনেকে নতুন ক্লাসের জন্য বই-খাতা ও অন্যান্য জিনিস কিনতে আসেন। আমার দোকান অনেক পুরোনা হওয়ায় কিছু নির্ধারিত ক্রেতা এখান থেকে সব কেনেন। বর্তমানে অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়ায় তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য হচ্ছে। অনেকে সব উপকরণ না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, গত তিন মাস আগে ৮০ পৃষ্ঠার অপসেট কাগজের একটি বাইন্ডিং খাতা ২৫ টাকায় বিক্রি করতাম। বর্তমানে সেটি ৩৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম ৩০-৫০ শতাংশ বেড়েছে। তাই ক্রেতারা কিনতে চাচ্ছেন না। শুধু খাতা নয়, চায়না থেকে আমদানি করা জ্যামিতি বক্স, স্কেল, পেন্সিল, কলমসহ সব কিছুর দাম ৪০-৫০ শতাংশ বেড়েছে। সৃজনশীল ও সহায়ক বইও ২৫-৩০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

পাশেই অংকুর বই বাজার নামে দোকানে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত মাত্র এক দিস্তা কাগজ বিক্রি করতে পেরেছেন জানিয়ে বিক্রেতা সুমন জাগো নিউজকে বলেন, হোয়াইট পেজের খোলা ২৪ পৃষ্ঠা আগে ১৫ টাকায় বিক্রি করা হতো, গত এক মাসে সেটি ১০ টাকা বেড়েছে। এখন সেটি ২৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। সব ধরনের খাতা-কাগজের দাম বেড়ে গেছে। আগে যারা ৮-১০টি খাতা বা দিস্তা হিসেবে কিনতো এখন তারা দু-তিনটি কিনছেন।

‘উপন্যাস-গল্পের সৃজনশীল বই আগে যেটি ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বর্তমানে সেটি ১০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে বলে বিক্রি অনেক কমে গেছে। চাকরির প্রস্তুতিমলূক বইয়ের দামও ৩০-৪০ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সব ধরনের স্টেশনারি ও খাতাপত্রের দাম। বর্তমানে যে পরিমাণে বিক্রি হচ্ছে তা দিয়ে দোকান ভাড়া ও কর্মচারীর বেতন পরিশোধ করে পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’
মেয়ের জন্য এসএসসির মডেল টেস্ট পেপার কিনে যাওয়ার সময় বাদশা নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী অভিভাবক জাগো নিউজকে বলেন, আমার তিন মেয়ে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়, একজন কলেজ আর একজন আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। যেভাবে বই-খাতার দাম বেড়ে গেছে তাতে চাকরি করে মেয়েদের পড়ালেখা চালিয়ে ভালোভাবে সংসার চালানো যাবে না।

তিনি বলেন, গত বছর মেজ মেয়ের জন্য যে টেস্ট পেপার আড়াই হাজার টাকায় কিনেছি, সেটি এক বছরের ব্যবধানে সাড়ে ৪ হাজার টাকা হয়ে গেছে। অনেক বলেও কমাতে পারিনি। মেয়ের জন্য কয়েকটি খাতা, জ্যামিতি বক্স ও অন্যান্য জিনিস কিনতে হয়েছে। আগের চেয়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি দাম নিয়েছে। বাসা থেকে যে বাজেট নিয়ে এসেছিলাম দাম বেড়ে যাওয়ায় সব কিছু কেনা সম্ভব হয়নি।

বই-খাতার বড় মার্কেট নীলক্ষেত। এখানে পপি লাইব্রেরি অ্যান্ড স্টেশনারির মালিক লিমন রাব্বী জাগো নিউজকে বলেন, এ সময় খাতা-নোট, নানান ধরনের শিক্ষা উপকরণ বিক্রির সময়। সামনে এসএসসির মডেল টেস্ট শুরু হবে। এমন সময়ও আমাদের খাতা-নোট বিক্রি কমে গেছে। প্রতিটি খাতা আগের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেশিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। সে কারণে অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনছেন। বাড়তি দামে অর্ডার করেও ভালো মানের খাতা পাওয়া যাচ্ছে না।

পাশেই মায়ের দোয়া স্টেশনারি ও বুক বিতানের বিক্রেতা হাবিব জানান, খাতার দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে তারা দোকানে মালামাল কিনছেন না। বর্তমানে শুধু বই বিক্রি করছেন।

জানা যায়, বিশ্ববাজারে ডলার ও জ্বালানির দর ঊর্ধ্বগতি হওয়ায় কাগজের কাঁচামালের (পাল্প) দাম বেড়ে গেছে। কাগজকে প্রসাধনী পণ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করায় বর্তমানে সেটি আমদানি করা প্রায় বন্ধ রয়েছে। তার ওপর দেশে ডলার সংকট হওয়ায় কাগজ তৈরির পাল্প আমদানি কঠিন হয়ে পড়েছে। সে কারণে হঠাৎ করে কাগজের দাম অনেক বেড়ে গেছে। যদিও কাগজ মিল মালিক ও কাগজ বিক্রেতাদের সিন্ডিকেটের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, দেশে চরমভাবে কাগজের সংকট তৈরি হয়েছে। বিশ্ববাজারে যে পরিমাণে কাগজ তৈরির পাল্পের দাম বেড়েছে তার চেয়ে দুই থেকে আড়াই গুণ দাম আদায় করা হচ্ছে। সে কারণে খাতা, নোট, প্যাডসহ কাগজের তৈরি সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন যে, বেশি দামে কাগজ অর্ডার দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন এর দাম বাড়ছে। কাগজ সংকট বলে একাডেমিক সহায়ক ও সৃজনশীল বইয়ের দাম বেড়ে গেছে। প্রয়োজনীয় বই ছাপাতে কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, কাগজ সংকটের কারণে সরকারের বিনামূল্যের বই তৈরির কাজে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। আগামী বছরের একাডেমিক সহায়ক বই প্রণয়ন করা যাচ্ছে না। শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না বইমেলার জন্য সৃজনশীল বই প্রকাশনার কাজও। এ সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে দ্রুতসময়ের মধ্যে বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি করতে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে হবে। নতুবা নতুন বছরে শিক্ষাব্যবস্থা বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়বে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top