জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক….
গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা এবং জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দলকে চাঙা রাখতে সম্মেলন করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জেলা-উপজেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সম্মেলন হলেও নেতৃত্বে আসছে না তেমন কোনো পরিবর্তন। এতে সাময়িক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দল। জট বাড়ছে পদপ্রত্যাশী নেতৃত্বের। ছাত্রলীগ করে আসা বিপুল সংখ্যক নেতা নিষ্ক্রিয় থাকছেন পদ না পেয়ে।
দলীয় তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলা ৭৮টি। এরমধ্যে ৩৯টির সম্মেলন হয়েছে, সম্মেলন হয়নি বাকি ৩৯টির। সম্মেলন হওয়া ৩৯টির মধ্যে প্রায় সবকটিতেই সভাপতি-সম্পাদক নির্ভর কমিটি হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে মাত্র ৭টি জেলা। অন্যদিকে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়নি ২৪টিতে এবং নেতৃত্বের আংশিক পরিবর্তন হয়েছে ৮টিতে। উপজেলা পর্যায়েও একই চিত্র। ১৫ থেকে ১৮/২০ বছর সম্মেলন হয়নি, এমন উপজেলায় সম্মেলন হয়েছে। তবে সম্মেলনের পর আগের নেতৃত্ব বহাল রাখায় ক্ষোভ বাড়ছে তৃণমূলে।
একই অবস্থা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগেও। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে দলটি ৪ বার সম্মেলন করলেও নতুন নেতা তৈরি করেছে মাত্র ৭৭ জন। এরমধ্যে সভাপতি পদে পরিবর্তন না থাকলেও সাধারণ সম্পাদক পদে মাত্র দু’বার পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল ৭৫ সদস্যের, নতুন নেতা হয়েছেন ২০ জন। ২০১২ সালের সম্মেলনে ৭৫ সদস্যের কমিটিতে নতুন নেতা হয়েছেন ১২ জন। ২০১৬ সালের সম্মেলনে ৮১ সদস্যের কমিটিতে নতুন মুখ এসেছে ২৮। ২০১৯ সালের সম্মেলনেও ৮১ সদস্যের কমিটিতে নতুন মুখ ছিল ১৭ জন। আসন্ন ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আগে শোনা যাচ্ছে, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ সিংহভাগ পদে থাকছে না পরিবর্তন। মৃত্যুজনিত কারণে শূন্য হওয়া পদ পূরণ করা বা দায়িত্ব পুনর্বণ্টন ছাড়া, নেতৃত্বে তেমন পরিবর্তন আসবে না বলেই শোনা যাচ্ছে।
এর ফলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, সবখানেই বাড়ছে পদপ্রত্যাশী নেতৃত্বের জট। ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ বিভিন্ন সংগঠন করে আসা বিপুল সংখ্যক নেতা পদ না পেয়ে নিষ্ক্রিয় থাকছেন।
তবে বিষয়টিকে সহজভাবেই নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বে থাকা নেতারা। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সবাই বলছেন, দলে যেমন নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন আছে, তেমনি অভিজ্ঞদেরও প্রয়োজন। সামনে নির্বাচন, এসময় বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলায় দলের অভিজ্ঞ নেতৃত্ব সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, সম্মেলন করা মানেই বর্তমান নেতৃত্বকে উৎখাত করা নয়। একটি জেলা বা উপজেলায় যারা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তারা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেন। তাদের পরিবর্তন করতেই হবে, এমন কোনো সূত্র নেই। তবে বাস্তবতার কারণে কেউ ইমেজ হারিয়ে ফেললে অথবা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়লে অথবা দলের বৃহত্তর স্বার্থে নেতৃত্ব পরিবর্তন করা হয়, হচ্ছে। অনেক সম্মেলনে নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়েছে। অনেক জায়গায় হয়নি।
তিনি আরও বলেন, দল শুধু সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রিক নয়। অন্যান্য পদে পরিবর্তন হয়। অন্যান্য পদগুলো নেতা তৈরির একেকটি পিলার।
এ নিয়ে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু জাহির এমপি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি প্রাচীন ও বৃহৎ গণতান্ত্রিক সংগঠন। নতুন ও পুরাতনের সমন্বয়ে দল পরিচালিত হয়। দলে অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের মতো বয়সের কোনো বিধিনিষেধ নাই। নতুন নেতৃত্ব যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি অভিজ্ঞদেরও প্রয়োজন আছে। কোথাও যদি দীর্ঘদিনের সক্রিয় এবং সিনিয়র নেতার ওপর স্থানীয় নেতাকর্মীরা আস্থা রাখেন, আর নেতৃত্বে তাকে রেখে দেওয়া হয়, তাহলে কোনো ক্ষতি নেই।
বরং নতুন-পুরাতনের মিলনে দল আরও শক্তিশালী হবে বলে আমার বিশ্বাস, মন্তব্য করেন তিনি।
লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোটে নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপি বলেন, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দেন, তারা ওই এলাকার সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ সংগঠক। একজন অভিজ্ঞ এবং দক্ষ সংগঠকের প্রয়োজন দলে অনেক বেশি। সে কারণে যেখানে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ সংগঠক আছে, তাদের পুনরায় রাখা হয়। তরুণ নেতৃত্বও আনা হয়। তাদের হয়তো সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে না দিয়ে, বাকি ৭৫ সদস্যের যেকোনো পদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কোথাও কোথাও জেলায় নতুন নেতৃত্বের প্রয়োজন দেখা দিলে এবং যোগ্য, তরুণ নেতৃত্ব পাওয়া গেলে সভাপতি-সম্পাদক পদেও পরিবর্তন করা হয়।
তিনি বলেন, সুতরাং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদক পদে পুরোনোদের রাখলে দলের কোনো ক্ষতি হবে বলে আমি মনে করি না। বরং আগামীতে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন মোকাবিলা, সামনে নির্বাচনের ফল ঘরে আনার জন্য পুরোনো ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
ঢাকা বিভাগ
ঢাকা বিভাগে রয়েছে ১৭টি সাংগঠনিক জেলা শাখা। এরমধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ মহানগর, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও কিশোরগঞ্জ, এই ৭টির সম্মেলন হয়নি। ১০টির সম্মেলন হয়েছে। তার মধ্যে নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলা শাখা। বাকি ৭টিতেই পুরোনো নেতৃত্ব।
৮ বছর পর বেশ হাঁকডাকে সম্মেলন হয়েছে ঢাকা জেলার। এ শাখায় ২০০৪ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসা বেনজিরই রয়ে গেছেন সভাপতি। তবে সম্পাদক পদে আসছে পরিবর্তন। গাজীপুর জেলা এবং মহানগরেও হয়নি নেতৃত্বের পরিবর্তন। দীর্ঘ ৭ বছর পর সম্মেলন হলেও নরসিংদীতে ভারপ্রাপ্তদের ভারমুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ৭ বছর পর সম্মেলন হয়েছে রাজবাড়ি ও টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের। এগুলোতে নেতৃত্বের নেই পরিবর্তন। একই অবস্থা মানিকগঞ্জের।
চট্টগ্রাম বিভাগ
এই বিভাগে সাংগঠনিক জেলা ১৫টি। সম্মেলন হয়েছে ৮টিতে। মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি ৫টির। বাকি দুটির সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেও স্থগিত করা হয়েছে। সম্মেলন হওয়া ৮টির সবগুলোতেই বহাল আছে পুরোনো নেতৃত্ব।
খুলনা বিভাগ
সাংগঠনিক জেলা ১১টি। সম্মেলন হয়েছে ৪টিতে। সবগুলোতেই বহাল রয়েছে পুরোনো নেতৃত্ব। বাকি ৭টির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি। এগুলো হলো- কুষ্টিয়া, নড়াইল, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষিরা, খুলনা জেলা ও মহানগর শাখা।
বরিশাল বিভাগ
এই বিভাগে সাংগঠনিক জেলা ইউনিট ৬টি। তারমধ্যে ঝালকাঠি ও পটুয়াখালী শাখার কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়নি। বাকি চারটির তিনটিতে সম্মেলন হলেও নেতৃত্ব অপরিবর্তিত। হয়নি বরিশাল জেলা সম্মেলন। জাতীয় সম্মেলনের আগে সম্মেলন হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন।
এই বিভাগের বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে ৩০ বছরে সাত বার। প্রতিবারই একই নেতৃত্ব রয়ে গেছে। ৭ বছর পর কমিটি করলেও পিরোজপুরে বহাল পুরোনো নেতৃত্ব। শুধু ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আংশিক পরিবর্তন হয়েছে।
রাজশাহী বিভাগ
এই বিভাগে আওয়ামী লীগের ৯ টি সাংগঠনিক জেলা শাখা। ৯টির মাঝে বগুড়া, রাজশাহী জেলা ও মহানগর শাখার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি। বাকি ৬টির সম্মেলন হয়েছে। ৬টির মাঝে নতুন নেতৃত্ব পেয়েছে জয়পুরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বাকিগুলোতে বহাল পুরোনো নেতৃত্ব।
সম্মেলন হয়নি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের।
রংপুর বিভাগ
এই বিভাগে সাংগঠনিক জেলা ১০টি। ১০টির মাঝে মাত্র তিনটিতে সম্মেলন হয়েছে। এরমধ্যে গাইবান্ধা পেয়েছে নতুন নেতৃত্ব। দিনাজপুরে নেতৃত্বে আছেন পুরোনো সভাপতি। পঞ্চগড়ে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়নি- কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, রংপুর জেলা ও মহানগর শাখার।
দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ফাইল ছবি
সিলেট বিভাগ
পাঁচটি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে এই মেয়াদে একটিরও সম্মেলন করা হয়নি। গত সম্মেলনের আগ মুহূর্তে সম্মেলন হয়েছিল হবিগঞ্জ, সিলেট জেলা ও মহানগর শাখার। সে কারণে এগুলোকে মেয়াদোত্তীর্ণ ধরা হয়নি। আর মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও সম্মেলন হয়নি মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলা শাখার।
ময়মনসিংহ বিভাগ
ময়সনসিংহ বিভাগের জেলা ইউনিট ৫টি। সবগুলোরই সম্মেলন হলেও নতুন নেতৃত্ব এসেছে মাত্র একটিতে। ছয় বছর পর ময়মসিংহ জেলা ও মহানগরে হয়েছে সম্মেলন। ইউনিট দুটিতে সভাপতি পদে পরিবর্তন হলেও অপরিবর্তিত রয়েছেন সাধারণ সম্পাদক।
শেরপুরে প্রায় ৮ বছর পর সম্মেলন হলেও সভাপতি পদে হ্যাট্রিক করেছেন হুইপ আতিক। তবে পরিবর্তন হয়েছে সাধারণ সম্পাদক পদে। একই অবস্থা জামালপুরেও। দীর্ঘ ৭ বছর পর নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে, এসেছে নতুন নেতৃত্ব।