ডেস্ক রিপোর্ট: কক্সবাজারের টেকনাফের একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের ইয়াবা গডফাদার খ্যাত সংসদ-সদস্য আবদুর রহমান বদিকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। বুধবার কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হামীমুন তানজিনের আদালত এ আদেশ দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জীবন রায় চৌধুরী ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলেও বদি করজোড়ে অসুস্থতার কথা জানালে চার্জ ওয়ারেন্ট মূলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার জিইসি মোড়ের একটি আবাসিক এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। রাতেই তাকে নিয়ে আসা হয় কক্সবাজারে। পরে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে র্যাব। বিকালে হেলমেট পরিয়ে তাকে ঢোকানো হয় আদালতের এজলাস কক্ষে। সতর্ক অবস্থানে ছিলেন সেনা, র্যাব ও পুলিশের সদস্যরা। ছিল হাজারো উৎসুক জনতা। তারা বদির ফাঁসির দাবি করে নানা স্লোগান দেন।
গডফাদার বদিতে মুগ্ধ ছিলেন শেখ হাসিনা : সব অপরাধের শীর্ষে নাম উঠে এলেও আবদুর রহমান বদিতে মুগ্ধ ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখে এমন কথা শোনা গেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, বদিকে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের ম্যাজিকম্যান ও শক্তি বলে মনে করতেন শেখ হাসিনা। এমনকি কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও বদিই নির্বাচিত হবে এমনটা বিশ্বাস করতেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এ কারণে মাদকসহ নানা অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বদির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করলেও বদির অপরাধ সাম্রাজ্য ছুঁতে নিষেধ করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমনকি বদির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে গত দুটি সংসদ নির্বাচনে বদির স্ত্রী শাহীন আক্তারকে মনোনয়ন দেন শেখ হাসিনা। দ্বাদশ সংসদে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন এমন দুজন আওয়ামী লীগ নেতা জানান, মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের উদ্দেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বদিকে নিয়ে নতুন করে আমাকে কিছু বলতে হবে না, আমি সব জানি। আপনার কেউ যদি ভবিষ্যতে মনোনয়ন পেতে চান তাহলে আবদুর রহমান বদির মতো যোগ্য হয়ে আসুন। জানা গেছে, বদি ১৯৯৬ সালে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। পরে ২০০৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। ওই বছর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় বদি জানান, তিনি বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে বছরে এক লাখ ৭৬ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ার থেকে ৯১ হাজার ৯৮ টাকা এবং ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা আয় করেন লবণ মাঠ থেকে। অর্থাৎ তার বার্ষিক আয় তিন লাখ টাকার কম ছিল সে সময়। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, তার ওপর নির্ভরশীলরা বছরে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা আয় করেন।
তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বদি জানান, তিনি কৃষি থেকে চার হাজার ৬৫০ টাকা, বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া থেকে দুই কোটি আট লাখ, ব্যবসা থেকে পাঁচ কোটি ৩২ লাখ, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ার থেকে আট কোটি পাঁচ লাখ এবং লবণের মাঠ থেকে ৯১ হাজার টাকা আয় করেন বছরে। এই হিসাবে তখন বদির বছরে আয় দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং তার ওপর নির্ভরশীলদের আয় দাঁড়ায় তিন কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
অপরাধের তিন তালিকায়ই শীর্ষে বদি : মানব পাচার, ইয়াবা ও রোহিঙ্গাদের বৈধকরণ, এই তিন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে টালমাটাল পর্যটন জেলা কক্সবাজারসহ পুরোদেশ। এই তিন অপরাধেরই প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসাবে নাম এসেছে বদির নাম, সঙ্গে ছিলেন তার ছয় ভাইসহ ২৬ জন কাছের ও দূরের আত্মীয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা টেকনাফের শীর্ষ ৭৯ মানব পাচারকারীর তালিকায় বদির নাম ছিল ১ নম্বরে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তালিকাটি করা হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে আরেকটি তদন্ত হয়। তাতেও বদিসহ তার আট আত্মীয়দের মানব পাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকায়ও বদিকে মাদকের মূল পৃষ্ঠপোষক বলা হয়। ওই তালিকায় তার ১৭ জন আত্মীয়ের নাম আছে। গত ১৭ এপ্রিল বদির দুই ভাইয়ের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কক্সবাজারের ১০ মাদক গডফাদারের মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের সংশ্লিষ্টতা মিলেছে বলে জানায় সংস্থাটি। অভিযোগ আছে, বদির সম্পদের একটি বড় অংশই গড়ে ওঠে মিয়ানমার থেকে আসা মাদক বিক্রির টাকায়। গত কয়েক বছর ধরে বহুবার এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বদিকে মাদকের গডফাদার হিসাবে চিহ্নিত করেছে একাধিকবার।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইয়াবার অন্য বড় পাচারকারী বা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বদির মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এই কাজ করতে পারবেন না। প্রতিবেদন অনুযায়ী বদির ভাই মুজিবুর রহমান ও আবদুল শুক্কুর এবং চাচাতো ভাই মং মং সেনও ইয়াবার গডফাদার হিসাবে পরিচিত। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কক্সবাজারে ইয়াবার ১২০ জন তালিকাভুক্ত পাচারকারী আছে। আর সবার আগে নাম আছে বদির।
বদিকে নিয়ে আলোচনায় আছেন যখন-তখন মারধর ও বিপুল বিত্তবৈভবের কারণেও। মাদকের টাকায় কর দিয়ে এনবিআর থেকে নিয়েছেন তিনি ‘সর্বোচ্চ করদাতার’ প্রেস্টিজিয়াস ক্রেস্টও। দুদকের মামলায় কারাগারেও যেতে হয়েছে টেকনাফের সমালোচিত সাবেক এ এমপিকে।
বদির পুরো পরিবার ইয়াবায় অভিযুক্ত : শুধু আবদুর রহমান বদি নয়, তার পুরো পরিবারই ইয়াবায় অভিযুক্ত। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে পাইলট স্কুল মাঠে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের হাতে অস্ত্র ও ইয়াবা জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করা ১০২ জন ইয়াবা কারবারির মধ্যে বদির আপন চার ভাইসহ ১৩ স্বজন রয়েছে। তার ভাইদের মধ্যে ছিলেন-আবদুস শুক্কুর, আমিনুর রহমান, মো. ফয়সাল রহমান ও শফিকুল ইসলাম। এছাড়া বদির ভাগিনা সাহেদ রহমান নিপু, ফুপাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেল, খালাতো ভাই মংমং সেন ও বেয়াই শাহেদ কামালসহ মোট ১৩ জন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সিআইডি করা ইয়াবা গডফাদারদের নামের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বদির আপন তিন ভাইয়ের নাম। এ ছাড়া ইয়াবা পাচারে ব্যবহৃত গাড়ির তালিকায়ও রয়েছে বদি পরিবারের গাড়ির নাম। ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর টেকনাফ পৌরসভার সাজ্জাদ হোসাইন ও দমদমিয়া এলাকার মো. জাবেরকে ৫০ হাজার ইয়াবাসহ আটক করে বিজিবি। বদির ছোট ভাই আবদুল শুক্কুর মিয়ানমার থেকে বিশাল এই ইয়াবার চালান টেকনাফে নিয়ে আসে বলে বিজিবিকে জানিয়েছিল আটকরা। টেকনাফ থানায় বদির ভাইকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়। সর্বশেষ এ খাতায় যুক্ত হয়েছে বদির স্ত্রীও। ২০১৪ সালে যানবাহনে ইয়াবা রাখার অভিযোগে আটক করা হয় বদির ২য় স্ত্রী সাকিকেও।