প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নির্বাচন করাই সরকারের লক্ষ্য

image-839802-1724011868.jpg

ডেস্ক রিপোর্ট: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরই দেশে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। কাজগুলো করে যত দ্রুত সম্ভব একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেওয়া এই সরকারের লক্ষ্য। সংস্কারের মধ্যে আছে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও গণমাধ্যম। তবে এ মুহূর্তে সরকারের অগ্রাধিকার খাত হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখা এবং অর্থনীতি। রোববার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ব্রিফিং শেষে প্রধান উপদেষ্টার তথ্যসচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের এসব কথা বলেছেন। এ সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বিদেশিদের কাছে তুলে ধরেন তিনি। এছাড়াও আগামী দিনে দেশ পরিচালনায় বিদেশিদের পাশে থাকার আহ্বান জানান। দায়িত্ব গ্রহণের পর এটিই ছিল কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রথম আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং।

শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি এবং চরম অব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশের শিক্ষার্থীদের এত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। দুনিয়ার কোথাও নাগরিকরা এতটা মানবাধিকারবঞ্চিত হননি।’ তিনি বলেন, ‘এখন অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানোই এই সরকারের অগ্রাধিকার। বিগত সরকারের কারণে দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। এটা ঠিক করতে কিছুটা সময় লাগবে।’ তিনি বলেন, ‘আশা করি, নতুন বাংলাদেশ তৈরিতে সবাই পাশে থাকবেন।’ প্রফেসর ড. ইউনূস বলেন, ‘বিগত নির্বাচনগুলোয় ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। ক্ষমতা ধরে রাখতে শেখ হাসিনা সরকার সব প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। অনিয়ম আর দুর্নীতি সর্বত্র। সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে।’ যারা এ আন্দোলনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছাত্রদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন বলে জানান।

তিনি বলেন, ‘এমন একটি সময়ে এসে দেশের দায়িত্ব নিয়েছি, যখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই চরম বিশৃঙ্খলা। তাই নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করবে।’ ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বন্ধুদের মধ্যে থাকতে পেরে আনন্দিত। দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে। শেখ হাসিনার নৃশংস স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল লাখো বীর ছাত্র-জনতা। কিন্তু তার দলের ছাত্র সংগঠন এবং শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দেশে ভয়াবহতম বেসামরিক গণহত্যা চালানোর পর তিনি (শেখ হাসিনা) দেশ ছাড়েন। ইতোমধ্যে বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। দীর্ঘ দেড় দশকের নির্মম নৃশংসতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার দমন করা হয়েছিল। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম তাদের ভোটাধিকারের চর্চা না করেই বেড়ে উঠেছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট হয়েছে। আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুণ্ঠন করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার।’ ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি সেসব বীর ছাত্র ও নিরীহ মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই, যারা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। আমাদের সাম্প্রতিক স্মৃতিতে অন্য কোনো দেশের ছাত্রদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের জন্য এত মূল্য দিতে হয়নি। যেখানে বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়সংগত এবং পরিবেশবান্ধব একটি দেশের স্বপ্ন দেখতে হয়েছে, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘দেশ নিয়ে ছাত্রদের একটি স্বপ্ন আমাদের মুগ্ধ করেছে, যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়-নির্বিশেষে নিজেদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। সশস্ত্র বাহিনী বেসামরিক শক্তির সহায়তায় কাজ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না পরিস্থিতি নিশ্চিত হবে। সব ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকার।’ দেশে জুলাই-আগস্ট মাসে আন্দোলনে নিহত হওয়ার ঘটনায় জাতিসংঘের তদন্তকে স্বাগত জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি চান এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। তদন্তে জাতিসংঘকে বাংলাদেশ সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে। ড. ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ যত আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে, তার সব বাস্তবায়ন করবে সরকার।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের জন্য দায়িত্ব পালন করব। এরপর আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করব। জাতীয় ঐকমত্য বৃদ্ধির জন্যও আমরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাব।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নতুন যাত্রার এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের সাহসী ছাত্র ও জনগণের জন্য আমাদের জাতির স্থায়ী পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের যাত্রাটা কঠিন। তাদের আকাঙ্ক্ষা আমাদের পূরণ করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সেটা হয়, ততই ভালো। আমরা বিশ্বাস করি, একটি নতুন গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের যাত্রাপথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব বন্ধু ও অংশীদার আমাদের সরকার ও জনগণের পাশে দাঁড়াবে।’

পূর্বনির্ধারিত সময় অনুসারে প্রধান উপদেষ্টার ব্রিফিং শুরু হওয়ার কথা ছিল বেলা ১১টায়। কিন্তু তা শুরু হয় পৌনে ২ ঘণ্টা পর বেলা পৌনে ১টায়। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার আশপাশে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে জড়ো হয় বিগত দিনে চাকরি হারানো এবং সুবিধাবঞ্চিত কয়েকটি পেশার মানুষ। এর মধ্যে গ্রাম পুলিশ বা গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং আরও কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। তারা দাবি আদায়ে সকাল থেকেই বিক্ষোভ করতে থাকে। তাদের অবস্থানের কারণে গাড়িবহর নিয়ে বেড় হতে পারেননি প্রধান উপদেষ্টা। দাবি আদায়ে তারা ড. ইউনূসের সঙ্গেই কথা বলতে চান। তার কাছ থেকেই চান দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি। অনেক চেষ্টা শেষে পৌনে ২ ঘণ্টা পর বের হয়ে ব্রিফিংয়ে আসেন প্রধান উপদেষ্টা। ব্রিফিংয়ের শুরুতে বিলম্বের জন্য সবার কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন। বিলম্বে অনুষ্ঠান শুরুর ব্যাখ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, এ বিক্ষোভকে তিনি (ড. ইউনূস) সমর্থন করেন। কারণ, সবার বিক্ষোভ করার অধিকার আছে।

Share this post

scroll to top