নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে যা ভাবছেন সমন্বয়করা

image-837934-1723627085.jpg

ডেস্ক রিপোর্ট: সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাত্রা শুরু হলেও ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছে তারা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা কমিটিতেও রয়েছে তাদের দু’জন সমন্বয়ক।

এদিকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থাকায় রাজনীতির মাঠে হঠাৎ করেই বেশ উজ্জীবিত দেখা যাচ্ছে বিএনপিকে।

এসবের মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠন হবে কি না উঠছে সে প্রশ্নও। নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে কী ভাবছেন এর সমন্বয়করা?

গত ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ গ্রহণের পরই এ নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।

ওইদিন তিনি বলেছিলেন, জনগণ যদি মনে করে তরুণরাই রাষ্ট্রের হাল ধরবে তবে জনগণের সেই আহ্বানে সাড়া দেয়ার জন্য তরুণরা প্রস্তুত আছে।

পরদিন দুপুরে নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদের উপদেষ্টা হবার বিষয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম।

সেখানে তিনি লেখেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকার কারণে তাদের সামনের ইলেকশনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

এরপর থেকেই আলোচনায় আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি।

‘তাহলে কি এবার রাজনীতির মাঠেও দেখা যাবে সমন্বয়কদের’- এমন প্রশ্নের জবাবে সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, মানুষ ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল তরুণদের নেতৃত্বে দেখতে চায়, যারা সৎভাবে এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে বাংলাদেশে সুন্দর সমাজ গঠন করবে। বাংলাদেশের মানুষের চাওয়ার সে জায়গা থেকে আমাদের মনে হচ্ছে, জাতীয় পর্যায়ে আমরা একটি রাজনৈতিক চিন্তাধারায় যেতে পারি।

সরকার পতনের পর দল গঠনের বিষয়ে প্রথম ভাবনা আসে বলে জানান তিনি। তবে পুরো বিষয়টিই এখনো আলোচনার পর্যায়ে থাকায় কবে, কীভাবে এবং কোন কাঠামোতে দল গঠন হবে কিংবা কারা দলের নেতৃত্বে থাকবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি এই সমন্বয়ক।

এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রয়োজন ‘ফুরিয়ে এসেছে’ বলেই মত আরেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমার।

১০ আগস্ট ফেসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম। আমাদের নেতৃত্বদের মধ্যে ৬ জুলাই এর দিকেই এই প্ল্যাটফর্মকেন্দ্রীক একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে যায়। সেটা ছিল, এই আন্দোলনের মঞ্চ থেকে পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংগঠন হবে না। এই আন্দোলনের মঞ্চকে রাজনৈতিক কাঠামোতে পরিণত করলে আমাদের গণঅভ্যুত্থান তার আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্যুত হবে।

অনেক সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ভাবখানা এমন যেন তারা একটা কিছু! ছাত্র-জনতা একেকটা অবজেক্ট! নতুন স্বৈরাচার গজানোর আগেই ছাত্র-জনতার সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নয়তো এই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামক আমাদের আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তে গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হবে এবং দ্রুত মানুষের আস্থা হারাবে।

‘আমাদের বুঝতে হবে, কোথায় আমাদের থামতে হবে’ এভাবেই শেষ করেছেন এই সমন্বয়ক।

তাহলে কি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্তটি সমন্বয়কদের একটি অংশের? দল গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্তই বা কীভাবে নেওয়া হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে সমন্বয়ক সারজিস আলম জানান সব সমন্বয়ককে নিয়েই আলোচনা হচ্ছে।

সবার সিদ্ধান্তের আলোকে আমরা চিন্তা করছি আমরা এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামোতে যাব। আমরা সবাইকে একসঙ্গে রেখেই অফিসিয়াল ঘোষণা দেবো।

এদিকে রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলাপ চললেও রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।

সেক্ষেত্রে কেবল রাষ্ট্রের প্রয়োজন এবং জনতার চাহিদার ভিত্তিতে দল গঠনের বিষয়ে ভাবা হবে বলে জানান তিনি।

বলেন, বিদ্যমান লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে উঠেই কাজ করার সুযোগ যতক্ষণ থাকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে জায়গাটিতেই কাজ করতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবো। কিন্তু যখনই ছাত্র-নাগরিকদের চাহিদা তৈরি হবে যে পলিসি মেকিংয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়দের অংশ নেওয়া দেখতে চাই এবং সেটা নতুন ধরনের কোনো রাজনৈতিক এপ্রোচের মধ্য দিয়ে তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যারা রয়েছে তারা ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

অনেকটা একই কথা বলছেন আরেকজন সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে আমরা কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করবো কি না সেটি একটি সময়কালীন সিদ্ধান্ত। আমরা আশা করবো সবকিছু স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছানোর পর আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবো যে আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান কী হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতির অতীত ইতিহাস বলছে, সরকারে অবস্থান করে রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়টি জনসাধারণের কাছে সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এমন নয়।

এর আগে ১৯৭৫ সালের পর প্রচণ্ড গণঅসন্তোষের মধ্যে দিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয় এবং পরে জিয়াউর রহমান একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে। বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামের সেই দলটিই পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যায়।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। তিনিও সরকারে থেকে জাতীয় পার্টি গঠন করে এবং সেই দলটি পরে ক্ষমতায় বসে।

২০০৭ সালেও সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেছিল। বলা হতো কিংস পার্টি। ওই সময়ই আমরা দেখেছি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও একটি দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং পরে সেখানে থেকে ব্যাক আউট (সরে) করেন।

সব মিলিয়ে বর্তমান সরকারের অংশ হয়ে নতুন দল গঠনের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, সরকারে থেকে দল গঠন করার চেষ্টা সরকারের সুযোগ-সুবিধা বা রাষ্ট্রীয় আনুকল্য পেয়েই কিন্তু এই দল হয়, ফলে মানুষ এটা ভালোভাবে নেয় না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কথা বলে এসে পরে না আবার নিজেদের অনুকূলে সব নিয়ে নেন, এই ব্যাপারে তাদের সজাগ থাকতে হবে।

তবে সরকারে থাকার কারণে দল গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনাকে একেবারেই নাকচ করে দেন সমন্বয়ক সারজিস আলম।

তিনি বলেন, আমরা কখনো এটা মনে করি না। বরং তাদের ব্যক্তিত্বের ওপর বিশ্বাস করি যে তারা এটা চিন্তাই করে না। এমন ছোটোখাটো চিন্তা যদি আমাদের মধ্যে থাকতো, আমি এটুকু বলে দিতে পারি একটি কোটা সংস্কার আন্দোলন কোনোদিন স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়ে সফল হতে পারতো না।

বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে কিছু বলা নেই।

তবে এর আগে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল, তখন এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন।

কিন্তু কোনো দলের সদস্য যদি সরকারে থাকে, তবে সেই সরকারকে আর নিরপেক্ষ বলা যায় না বলেই মত মহিউদ্দিন আহমদের।

সেক্ষেত্রে নতুন দল গঠন করতে হলে সরকার থেকে ওই দলের সদস্যদের পদত্যাগ করা উচিৎ বলেই মনে করেন এই বিশ্লেষক।

তবে পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনাস্থা এবং গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে উত্থান হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে নতুন দল তৈরি হলে তা জনপ্রিয় হবার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে জনসাধারণ পরিবারতান্ত্রিক ধারায় অভ্যস্ত হওয়ায় সেখান থেকে সরিয়ে ‘গণতান্ত্রিক ধারায়’ আনার বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং হবে বলে ধারণা করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

Share this post

scroll to top