স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করার আহ্বান

1689082358.PM_.jpg

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট …….
সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ে পাঁচ দফা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও পেশ করেছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবার সুরক্ষা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই সুরক্ষিত নই।

মঙ্গলবার (১১ জুলাই) সকালে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘জনস্বাস্থ্য ও কূটনীতি’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি এ আহ্বান জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড মহামারি প্রমাণ করেছে, আমরা যতই নিজেদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভাবি না কেন, আমাদের সকলের ভাগ্য আসলে একসূত্রে গাঁথা। আমরা কেউই সুরক্ষিত নই যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারছি।

তিনি বলেন, সময় এসেছে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৩ ও অভীষ্ট-১৭-এর আলোকে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে কার্যকর বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার।

জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, এই উদ্দেশ্য পূরণে সুস্পষ্ট বৈশ্বিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি লক্ষ্য-অভিমুখী, নিবেদিত কূটনৈতিক তৎপরতার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ এই প্রচেষ্টার অগ্রভাগে থাকবে বলেও জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ প্রস্তাব
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মন্ত্রী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী আঞ্চলিক সহযোগিতা সংক্রান্ত পাঁচ দফা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা পেশ করেন।

প্রথমত, ভবিষ্যৎ জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করতে আমাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে;

দ্বিতীয়ত, নিরাময়যোগ্য সংক্রামক রোগ নির্মূল করতে এবং ক্রমবর্ধমান অসংক্রামক রোগের বিস্তাররোধে বিদ্যমান উত্তম চর্চা বিনিময়ে আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে;

তৃতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্যকে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূলধারায় যুক্ত করতে এবং পানিতে ডুবে যাওয়া ও দুর্ঘটনার মত প্রাণঘাতী জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় রোধে আমাদের মনোযোগী হতে হবে;

চতুর্থত, আমাদের নিজ নিজ স্বাস্থ্য শিক্ষা ও গবেষণা অবকাঠামোর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করতে হবে; বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেড়ে যাওয়া বিভিন্ন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের প্রাদুর্ভাব কমাতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে;

পঞ্চমত, মা, শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৩ অর্জনের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে এ অঞ্চলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আগামী ৭৫ বছর এবং তারও পরে যেন অর্থপূর্ণভাবে সমগ্র মানবতার সেবা করে যেতে পারে সে লক্ষ্যে আসুন আমরা একযোগে কাজ করি।

স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সারা দেশে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবাসহ ৩০টি অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে বিনামূল্যে ইনসুলিন প্রদানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এ মুহূর্তে একেকটি ক্লিনিকে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন সেবাপ্রার্থী সেবা গ্রহণ করছেন, যার মধ্যে ৮০ শতাংশ নারী ও শিশু। এছাড়া, সারা দেশে প্রায় চার হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবকালীন সেবাদান করা হচ্ছে বলেও জানান সরকারপ্রধান।

সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত একটি প্রস্তাবে বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা মডেলকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং একে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে অভিহিত করার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এটি আমার এবং আমাদের দেশের জন্য গর্বের।

বিগত বছরগুলোতে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে ধরে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের কাছে আমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বিগত সাড়ে চৌদ্দ বছরে সারা দেশে হাসপাতালগুলোর শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধিসহ চিকিৎসক, নার্স ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মেডিকেল শিক্ষার প্রসারে নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল ও হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, চিকিৎসা বিষয়ে বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় গবেষণা কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। স্থাপন করা হয়েছে হৃদরোগ, কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, নিউরো, চক্ষু, বার্ন, নাক-কান-গলাসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করার কাজ চলছে।

শিশু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির স্বীকৃতি হিসেবে ‘এমডিজি পুরস্কার ২০১০’ অর্জন করার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

সরকারপ্রধান আরও বলেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে পোলিও ও ধনুষ্টংকার মুক্ত ঘোষণা করেছে। কুষ্ঠরোগ পুরোপুরি নির্মূল হয়েছে, কালাজ্বর এখন প্রায় বিলুপ্ত, যক্ষ্ণা ও ম্যালেরিয়া নির্মূলের দিকে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষের কাছে সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

মা ও শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের জন্য ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১৩ লাখ উপকারভোগীকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

মানুষকে তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে টেলি মেডিসিন চালু প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে টেলি মেডিসিন সেবা চালু করা হয়েছে। সেইসঙ্গে চালু করা হয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রদানের জন্য হট লাইন। ‘মা টেলিহেলথ সার্ভিস’-এর মাধ্যমে প্রসূতি মায়ের গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী সেবাদান করা হচ্ছে।

স্মার্ট স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য ও জীবন ঝুঁকি হ্রাসকল্পে আমরা নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ট্রাস্ট গঠন করেছি। এ ট্রাস্টের আওতায় ‘বঙ্গবন্ধু প্রতিবন্ধী সুরক্ষা বীমা’ চালু করা হয়েছে।

প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদানের জন্য দেশের ৬৪টি জেলা ও ৩৯টি উপজেলায় মোট ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র পরিচালনা করা হচ্ছে। আরও ২১১টি কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের নানামুখী উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ এবং গুণগত মানোন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ২০০৬ সালের ৫৯ বছর থেকে বর্তমানে প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম খরচে চিকিৎসার মৌলিক চাহিদা পূরণের ধারাবাহিকতায় সরকার সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক, মিয়ানমারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. থেতখাইং উইন, ভুটানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাশো দেচেন ওয়াংমো, মালদ্বীপের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপমন্ত্রী সাফিয়া মোহামেদ সাঈদ, থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপমন্ত্রী বিজাভাত ইসরাভাকদি এবং বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ড. বারদান জং রানা।

স্বাগত বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার এবং সূচনা বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের ১১ সদস্য রাষ্ট্র হলো- বাংলাদেশ, ভুটান, গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ও তিমুর-লেস্তে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top