সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট…
গাজীপুরে কারখানা তৈরির কথা বলে ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ বাবদ নেয়া ৬৬ কোটি টাকা হাতিয়ে মো. মঞ্জুরুল আলম রতন নামে এক যুবক দুবাই চলে গেছেন। যাওয়ার আগে তিনি ব্যাংকে বন্ধক রাখা কারখানার কয়েক কোটি টাকার যন্ত্র রাতের আঁধারে বিক্রি করেছেন। ঘটনা জানাজানি হলে প্রতারণাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ওই যুবকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছে।
মঞ্জুরুল আলম রতন গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার উজিলাব গ্রামের খোরশেদ আলীর ছেলে। রতন তার প্রতিষ্ঠান দিহান নিটওয়্যার লিমিটেড এবং মেসার্স রতন এন্টারপ্রাইজের নামে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড মাওনা চৌরাস্তা শাখা থেকে ৬৬ কোটি টাকা ঋণ নেন। দুই মাস আগে তিনি মা, বাবা, ভাই, স্ত্রী এবং দুই সন্তান নিয়ে দুবাই পাড়ি জমিয়েছেন। রতনের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জামিনদার এবং মর্টগেজ দাতাদের নোটিশ দিয়েছে।
জানা যায়, মঞ্জুরুল আলম রতন ছাত্রাবস্থায় জমির ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। শিল্পকারখানার জমি কিনে দেয়ার সুবাদে বিভিন্ন কারখানার মালিকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। পাশাপাশি তিনি মাওনা চৌরাস্তার বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা প্রধানদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। তিনি এক পর্যায়ে স্থানীয় আজাহার মৃধার জমি লিজ নিয়ে কারখানা গড়ে তোলেন। এই কারখানার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেন তিনি।
রতন ব্যাংকের মর্টগেজেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান তার ঋণের জামিনদার এবং মর্টগেজ দাতারা। জমি ভাড়া নিয়ে সেই জমি নিজের দেখিয়ে ব্যাংক ঋণ নেন তিনি। এ অবস্থায় ব্যাংকে বন্ধক দেয়া সম্পত্তি বিক্রি করলেও ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ হবে না বলে জানিয়েছেন রতনের আত্মীয় প্রতিবেশীরা।
এদিকে রতন দেশ ছাড়ার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টাকা উদ্ধারে ঋণ সংক্রান্তে জড়িত ১৫ জনকে রতনের টাকা পরিশোধে নোটিশ দিয়েছে। এ ঘটনায় রতনের বিরুদ্ধে গাজীপুর আদালতে মামলা দায়েরও করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
ইসলামী ব্যাংক মাওনা শাখায় যোগাযোগ করে জানা যায়, মেসার্স রতন এন্টারপ্রাইজ এবং দিহান নিটওয়্যার নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ইসলামী ব্যাংক মাওনা শাখা থেকে রতনের নামে বিনিয়োগ করা হয় ২০১৫ সাল থেকে। পরে প্রতিবছর তা বৃদ্ধি করে সবশেষ রতনের কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় ৬৬ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রতন এন্টারপ্রাইজ শুধু কাগজে-কলমেই রয়েছে। বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই। আর দিহান নিটওয়্যার স্থানীয় এক ব্যক্তির ভাড়া করা জমির উপর তৈরি।স্থানীয় নাজমুল হুদার স্ত্রী দুলেনা খাতুন রতনের প্রতিবেশী। রতনের সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল। হঠাৎ একদিন রতন তার বাড়ি গিয়ে সাক্ষীর কথা বলে একটি কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। দুলেনা খাতুন বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, এখন ব্যাংক বাড়িতে নোটিশ পাঠিয়েছে। কোনো দিন ব্যাংকে যাইনি, ব্যাংকের কেউ আসেনি, এখন বলছে টাকা পরিশোধ করার জন্য। আমরা এত টাকা কোথায় পাবো?
স্থানীয় আজাহার মৃধা বলেন, আমার কাছ থেকে জমি কয়েক বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে রতন শেড নির্মাণ করেন। পরে ব্যাংক থেকে মেশিন দেয়া হয়। হঠাৎ করেই সে মেশিনগুলো বিক্রি করে দেয়। তার কাছে কয়েক মাসের ভাড়াও বাকি রয়েছে। সম্প্রতি ব্যাংক এসে কারখানায় মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।
রতনের বোন জামাই সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাউকে কিছু না বলেই তিনি (রতন) হঠাৎ করে সবাইকে নিয়ে দেশ ছেড়েছেন। পরে ফোনে বলেছেন দুবাই আছেন। সেখানে একটি ব্যবসাও খুলেছেন। এখন সব চাপ আমাদের উপরে আসছে।
ইসলামী ব্যাংক মাওনা শাখার ব্যবস্থাপক মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, রতন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে কারখানা চালানোর জন্য মেশিনগুলো ব্যাংকের টাকায় এনে দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো বিক্রি করে দেশ ছাড়ায় আমরা তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছি। তবে তাকে কীভাবে এত টাকা ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, কী অনিয়ম হয়েছে পুরো প্রক্রিয়াটির তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষ হলে তখন বলা যাবে কারা কীভাবে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
ইসলামী ব্যাংক মাওনা শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন বর্তমানে ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মরত। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মূলত তার আগের ব্যবস্থাপকের সময় তাকে (রতনকে) ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। তবে তার সময়ে তা বৃদ্ধি করে রতন ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ বাড়িয়ে নিয়েছে।
তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে তাকে আমরা সহযোগিতা করেছিলাম। তবে ব্যাংক এখান থেকে কোনো অনিয়ম করে সুবিধা নিয়েছে এটা আমার নলেজে নেই। বলেন মহিউদ্দিন।
এ বিষয়ে শ্রীপুর থানার ওসি এএফএম নাসিম বলেন, বিষয়টি নিয়ে থানায় এসেছিল মামলা করতে। পরে শুনেছি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে।