আমদানি বন্ধ-অতি মুনাফার লোভে মজুদ, দাম বাড়ছে পেঁয়াজের

1683638452.0.jpg

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট …..
ভোগ্যপণ্যের আকাশচুম্বী দামের সঙ্গে ক্রেতাদের নতুন করে ভোগাচ্ছে পেঁয়াজ। ১৫ দিনের ব্যবধানে পাইকারি ও খুচরা বাজারে এ মসলা পণ্যের দাম কেজিতে বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা।

বর্তমানে পাইকারিতে মানভেদে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। খুচরা বাজারে মানভেদে পেঁয়াজের দাম ঠেকেছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা।
এ ঊর্ধ্বমুখী দাম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা আসছে কোরবানির ঈদে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ, উৎপাদন কম হওয়া, শিলা বৃষ্টিতে নষ্ট, অতি মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা মজুদ করে বাজারে সংকট তৈরির চেষ্টা, সারের দাম বৃদ্ধি, পরিবহন ব্যয় ও চাঁদাবাজির কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, শ্যামবাজারে আমদানি ও দেশি দুই ধরনের পেঁয়াজ পাওয়া যায়। তবে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। যে কারণে দেশি পেঁয়াজের ওপর বাড়ছে চাপ। শিগগির পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি না দিলে দাম আরও বাড়বে। আর এর প্রভাব পড়বে কোরবানির ঈদে।

প্রসঙ্গত, কৃষকদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সরকার গত ১৫ মার্চ ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র বন্ধ করে দেয়। ফলে এখন চাহিদার পুরোটা মেটানো হচ্ছে দেশি পেঁয়াজে।

মঙ্গলবার (৯ মে) শ্যামবাজারের বিভিন্ন মোকাম ঘুরে দেখা যায় ছোট, মাঝারি ও বড়- তিন ধরনের পেঁয়াজ পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে। ছোট পেঁয়াজের পাইকারি মূল্য ৪২ থেকে ৪৫ টাকা। মাঝারি ও ভালো মানের বড় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। অথচ ঈদের আগে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ২২ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে। কোনো আড়তেই আমদানিকৃত পেঁয়াজ নেই। দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

পাইকারি বাজারগুলোয় দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। রাজধানীর সূত্রাপুর, রায়সাহেব বাজার, নয়াবাজার, ধূপখোলা মাঠসহ বিভিন্ন বাজারে দেশি পেঁয়াজ কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে অন্তত ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। অথচ, ঈদের আগে খুচরায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ কেনা যেত ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। কয়েক দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বাড়লেও তদারকি নেই কোনো সরকারি সংস্থার। তাই খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তাদের।

পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের পেঁয়াজের আড়ৎদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন মোকামে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ পেঁয়াজের ট্রাক ঢুকছে, যা চাহিদার তুলনায় কম। স্বাভাবিক সময়ে শ্যামবাজারে প্রতিদিন শুধু ৩০ থেকে ৪০ ট্রাক পেঁয়াজ ঢুকত। এখন শুধু দেশি পেঁয়াজ ঢুকছে। অন্যান্য সময় ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমার, পাকিস্তান, তুরস্কসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে পেঁয়াজবোঝাই ট্রাক শ্যামবাজারে আসতো। এখন তাও আসছে না। পাবনা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া থেকে পেঁয়াজ সরবরাহ হচ্ছে। কিছু পেঁয়াজ আসছে তাহেরপুর থেকে।

এ বিষয়ে শ্যামবাজারের আড়তদার মেসার্স রাজিব বাণিজ্য ভাণ্ডারের সত্ত্বাধিকারী প্রদেশ পোদ্দার বাংলানিউজকে বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ। এ কারণে সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে। দেশি পেঁয়াজ দিয়েই চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। তাই পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। এছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এক ট্রাক পেঁয়াজ আনকে খরচ ৯ হাজার টাকা, ভেন্ডার খরচ ২ হাজার টাকা, বস্তায় খরচ ১৮০০ টাকা এবং রাস্তায় নানা জায়গায় চাঁদা দিতে হয় ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা। এরপর পেঁয়াজের মূল্য নির্ধারণ করতে হয়। আমরা দামটা কমাবো কোথায়? আমদানির অনুমোদন দিলে একদিনে কেজি প্রতি ১০ টাকা কমে যাবে। তখন কৃষকদের চাঙ্গের পেঁয়াজও বাজারে চলে আসবে।

তিনি আরও বলেন, ফরিদপুরের ঝাটুরদিয়া বাজার থেকে প্রায় ৬ হাজার কেজি পেঁয়াজ এনেছি তিন লাখ ৯ হাজার ৫৫৩ টাকা খরচ পড়েছে। সে হিসেবে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ে ৫৩ দশমিক ৬২ টাকা। আর আমরা বিক্রি করছি সর্বোচ্চ ৫০ টাকা।

স্মৃতি বাণিজ্যালয়ের ম্যানেজার মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে মাঠে কোনো পেঁয়াজ নেই। এ বছর পেঁয়াজ উৎপাদন কম হয়েছে। শিলাবৃষ্টিতে কিছু নষ্ট হয়েছে। আমদানি বন্ধ, ফলে বেশি দামের আশায় পেঁয়াজের দেশীয় মহাজনরা বা পেঁয়াজের বড় ব্যবসায়ীরা চাঙ্গে মজুদ করে রেখেছে। তারা বাজারে পেঁয়াজ ছাড়ছে ধীর গতিতে। এতে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহে ঘাটতি পড়েছে। সরকারের উচিত হবে দ্রুত আমদানির অনুমতি দেওয়া। সামনে কুরবানির ঈদ, নইলে পেঁয়াজের দাম আরও বেড়ে যাবে।

সূত্রাপুর বাজারের খুচরা পেঁয়াজ ব্যবসায়ী বলরাম পোদ্দার জানিয়েছেন, আগে তারা ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনে বিক্রি করতেন ৩৫ থেকে ৪৫ টাকায়। এখন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে কিনে বিক্রি করছেন ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। দাম বাড়ার কারণ আড়তদাররা ভালো জানেন।

রায়সাহেব বাজারের খুচরা পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. কালাম বাংলানিউজকে বলেন, আমরা আড়ত থেকে দুই রকমের পেঁয়াজ কিনি। একটা বাছাই করা আর একটা বস্তা। বস্তার পেঁয়াজের দাম একটু কম। আর বাছাই করা পেঁয়াজের দাম বেশি। বস্তার পেঁয়াজ ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় কিনে ৬০ টাকা বিক্রি করি। আর বাছাই করা পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় কিনে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি করি। বেশি দাম দিয়ে কিনছি তাই বিক্রিও বেশি দামে করা হচ্ছে।

ভারত থেকে আমদানি বন্ধ থাকলেও দেশে পেঁয়াজের উৎপাদনের অবস্থা ভালো। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত চার বছরের ব্যবধানে দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন ১৩ লাখ টনের বেশি বেড়েছে। তবু অজানা কারণে বাড়ছে দাম।

এদিকে দাম বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখতে বাজার তদারকির ওপর জোর দিচ্ছে কনজ্যিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেছেন, প্রায় ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামে কয়েক মাস ধরেই সাধারণ মানুষ দিশেহারা। এতে নিদারুণ কষ্টে পরিবার নিয়ে সময় কাটছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের। জুনের শেষের দিকে কোরবানির ঈদ। তাই ঈদে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা এখন থেকেই পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে কিনা– সেটি খুঁজে বের করতে বাজার তদারকির বিকল্প নেই। দুর্ভাগ্য, এখনও মাঠ পর্যায়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

টিসিবির তথ্য বলছে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। এর মধ্যে রোজার চাহিদা ৫ লাখ টন। গত বছরের এই সময়ের চেয়ে বর্তমানে পেঁয়াজের দাম প্রায় ৭২ শতাংশ বেশি।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top