নিয়োগের হদিস নেই, কোটি টাকার বাণিজ্য শ্রমিক নেতাদের!

1680941793.IMG_20230402_123246.jpg

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট……
সাভারে কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে (ডেইরি ফার্ম) শাহ জালাল নামের এক ব্যক্তি মাস্টার রোলে (এমআর) অনিয়মিত শ্রমিক পদে চাকরির জন্য তিন বছর আগে প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. আসাদুর রহমানকে দুই মেয়াদে ৫ লাখ টাকা দেন। এরপর চাকরি দেওয়া কথা বলে নানা অযুহাতে ঘুরাতে থাকে আসাদুর রহমান।

একসময় শাহ জালালকে একটি নিয়োগ পত্র দিলেও তার বৈধতা নেই জানিয়ে চাকরি করতে দেয়নি ডেইরি ফার্ম কর্তৃপক্ষ।
সেই টাকা চাইতে গেলে নানা হুমকি ধামকির মুখোমুখি হতে হয় শাহ জালালকে। এতো টাকা শ্রমিক নেতা নামের এই ব্যক্তিকে দিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন শাহ জালাল ও তার পরিবার।

বুধবার (৫ এপ্রিল) সন্ধ্যায় কথা হয় শাহ জালালের সঙ্গে। শুধু শাহ জালালই নয়, তার মতো আরও শতাধিক চাকরি প্রার্থী বিভিন্ন মেয়াদে নানা অংকের টাকা চাকরির জন্য শ্রমিক নেতাদের কাছে দিয়ে হতাশায় আছেন।

ডেইরি ফার্মসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে জনবল নিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের পক্ষ থেকে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের একটি আবেদন করা হয়েছিল। সেই আবেদনে মাস্টাররোলের (নিয়মিত) পদে ১৩ জন ও মাস্টাররোল (অনিয়মিত) পদে ১১৪ জনসহ মোট ১২৭ জন শ্রমিক নিয়োগ হওয়ার কথা। তবে এই দুটি পদের নিয়োগের ব্যাপারে এখনো কোনো কার্যক্রমই শুরু হয়নি। আর কোথাও বিজ্ঞাপন বা নোটিশও দেওয়া হয়নি৷

শাহ জালাল বাংলানিউজকে বলেন, মাস্টাররোলে (এমআর) অনিয়মিত শ্রমিক পদে চাকরির জন্য আসাদুর রহমান কাকার কাছে প্রথমে ৭০ হাজার পরে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম তিন বছর আগে। লিখিত না থাকলেও যার একাধিক প্রতক্ষ্যদর্শী সাক্ষী আছে। চাকরি দেওয়ার কথা বলে শুধু ঘুরিয়ে তিন বছরে আমার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছেন তিনি। চাপাচাপির এক পর্যায়ে তিনি আমাকে একটি নিয়োগ পত্র দিলেও অফিস থেকে আমাকে কাজ করতে না করে দিয়েছে।

তার অভিযোগ, এখন টাকাও দেয় না, চাকরিও দেয় না। আসাদ কাকার বিষয়ে কাউকে কিছু বললে তিনি আমাকে বলেন, তুমি যাদের কাছে যাও তারা কী তোমাকে চাকরি দিতে পারবে? বা ডেইরি ফার্মের এমন কেউ নেই যে আমার কিছু করতে পারবে। এরকমভাবে আমাকে ও আমার পরিবারকে ভয়ে রাখতে চান তিনি। আসাদ কাকা আমার মতো ২০-২৫ জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।

অন্যদিকে বর্তমানে ডেইরি ফার্মে মাস্টাররোল (এমআর) পদে চাকরি করেন তাঁরা মিয়া। চাকরি জীবনের প্রায় শেষ সময় এসে পড়েছে তার। সে কারণে সাভার ডেইরি ফার্ম শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি আরিফুল ইসলামের কাছে ছেলের চাকরির জন্য ২ লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি।

রোববার (২ এপ্রিল) বিকেলে ডেইরি ফার্মের ভেতরে তাঁরা মিয়ার বাসায় গেলে তিনি না থাকায় কথা হয় তার স্ত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা ডেইরি ফার্মেই জীবন কাটিয়ে দিলাম। আমাদের পোলাপানও এখানেই হয়েছে। আমার স্বামীর চাকরির বয়স প্রায় শেষের দিকে। দুই ছেলে রিপন আর আলমাসকে বিয়ে দিয়েছি। এখন আমার স্বামীর চাকরি চলে গেলেও যেনে ডেইরিতে আসতে পারি সেজন্য এক ছেলের চাকরির জন্য যোগাযোগ করছিলাম আমাদের এক পরিচিত আত্নীয় মেহের কন্ট্রাক্টারের সঙ্গে। তিনি টাকা নিয়েছেন কিন্তু চাকরি দিতে পারেননি। সেটা জানতে পেরে আরিফ আমাদের কাছে এসে বলে চাকরি আমরা নিয়ে দেব। পরে আমার ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে ১ লাখ ও ঘরে থাকা ১ লাখ মিলিয়ে দুই লাখ টাকা আরিফের কাছে গত রোজায় দেই। আরিফ বলছে, চাকরি না দিতে পারলে টাকা ফেরত দিবে। ’

তিনি ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘কিন্তু সেই চাকরির কোনো খবর নেই। সবাই চাকরি নিয়ে ছোটাছুটি করছে কিন্তু আমাদের কোনো খবর নেই। আমাগো ভাগ্যে চাকরি নেই। টাকা দিয়েও আমরা চাকরি পাই না। ওই যে আমাগো চাইতে বেশি টাকা দিয়ে চাকরি নিয়ে নেয় অনেকই।

একই অভিযোগ সাভার ডেইরি ফার্ম শ্রমিক ইউনিয়নের বর্তমান কমিটির সদস্য ও মাস্টাররোল পদে কর্মরত গোলাম মোস্তফারও। তিনি ছেলের জন্য চাকরি প্রত্যাশী। তবে তার কোনো টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো আশ্বাস পাননি তিনি। তাই ছেলের চাকরির আশা বাদ দিয়েছেন তিনি।

গোলাম মোস্তফা বলেন, এক বছর আগে বর্তমান কমিটির সঙ্গে আমিও পাস করেছি। শুনতেছি ৬ মাস যাবত মাস্টাররোল পদে নিয়োগ হবে। আমার ছেলে ইন্টার পাস করেছে। তার চাকরির জন্য আমি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে মাঝে মধ্যেই বলি। তারা আমার কথা এড়িয়ে যান। আমার একটি দাবি আছে এই প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু ওরা দুর্নীতি করতেছে, করুক। তাদের সঙ্গে আমরা পারি না। চাকরি দেওয়ার কথা বলে টাকা দিয়ে বাইরে থেকে লোক এনে চাকরি দেয়। আমরা সদস্য হিসেবে কোনো সুবিধা পাই না। এটার নামই তো দুর্নীতি, এটা কে ধরবে বলেন?

তিনি এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে বলেন, এখন আমার মনে হয় আমি নিজে আত্মহত্যা করি৷। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৪০ বছর ধরে চাকরি করছি। তারপরও বাড়ি যাওয়ার সময় ভাড়াটা যোগাড় করতে হবে ধার করে। আমি চাকরি পাওয়ার পর শত শত লোক নিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। আমি আবেদন করেছি, তারা বলছে, ‘এই গোলাম মোস্তফা, বাদ দাও। অর্থাৎ আমি টাকা দেইনি দেখে বাদ হয়ে গেল আমার আবেদন’।

সাভার ডেইরি ফার্ম শ্রমকি ইউনিয়নের সভাপতি মো. আসাদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মো. মাসুদ মুন্সিসহ আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে এক সংবাদকর্মীকে মারধরের পর থেকেই তারা পলাতক আছেনে। তাই তাদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। গত দুই তিন দিন থেকে তাদের ইউনিয়ন অফিসে বসতে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন ডেইরি এলাকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার সাভারের পরিচালক ডা. মো. মনিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমি নতুন, দুই মাস হলো এখানে এসেছি। এ ধরনের অসঙ্গতির বিষয়ে আমার এখনো জানা নেই। যদি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকে সে ক্ষেত্রে আমি ব্যবস্থা নেব। চাকরির কথা বলে যদি ডেইরি ফার্মের কেউ টাকা নিয়ে থাকে তবে তার যথাযথ প্রমাণ পেলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top