‘বাবা, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে?’

RAKIB-2301301416.webp

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক …..

ছেলে ফারহান উদ্দিন আর মেয়ে লাইবা রহমানকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল রাকিব উদ্দিন আহম্মেদ ও মুন্নী রহমানের। কিন্তু, হঠাৎ সেই সংসারে নেমে আসে অশান্তির ঘনঘটা। ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) জুনিয়র সহকারী ম্যানেজার রাকিব উদ্দিন। তার স্বজনরা জানান, অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ঋণ করেন রাকিব। ভবিষ্যতে কী হবে, এমন চিন্তায় স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে খুন করেন তিনি। স্ত্রী-মেয়ে খুনের আগে কিছুই টের পায়নি। তবে, ছেলে ফারহান টের পেয়ে যায় যে, বাবা তাকে খুন করবে। তখন সে বলে, ‘বাবা, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে?’

তিন বছর আগে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটে রাজধানীর দক্ষিণখানে। এ ঘটনায় নিহত মুন্নীর ভাই মুন্না আহমেদ দক্ষিণখান থানায় রাকিব উদ্দিন আহম্মেদকে আসামি করে মামলা করেন। ঘটনার বছরখানেক পর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাকিবকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) বিমানবন্দর জোনাল টিমের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মিজানুর রহমান। সে মামলার রায় ঘোষণার দিন আগামীকাল মঙ্গলবার (৩১জানুয়ারি) ধার্য রয়েছে। ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ তেহসিন ইফতেখারের আদালত এ চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করবেন। রায়ে কারাগারে আটক রাকিবের ফাঁসির দাবি জানিয়েছে নিহতের স্বজনরা।

নিহত মুন্নীর ভাই মুন্না আহমেদ বলেন, গত ২২ জানুয়ারি মামলাটির রায়ের তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু, বিশ্ব ইজতেমার কারণে আসামিকে হাজির করা হয়নি। ৩১ জানুয়ারি রায়ের তারিখ ধার্য রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নির হত্যাকারীর ফাঁসি হোক। এখন দেখা যাক, আদালত কী করে। যদিও মামলা শেষ হতে সময়টা বেশি লেগেছে। লম্বা সময় নিয়েছে তদন্তে। তারপরও শেষ পর্যন্ত রায় আসছে।

তিনি বলেন, রায়ে সন্তুষ্ট না হলেও আমার আর কিছু করার নেই। করোনার পর থেকে বেকার আছি। মামলা চালাতে গিয়ে আমার দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তিনজনের লাশ মর্গ থেকে আনতেই ডোমকে দিতে হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। বন্ধুদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে লাশ নিয়ে আসি। এখনো বেকার আছি। টাকা খরচ করার সামর্থ্য আমার নেই। কাজেই আমার আর কিছু করার থাকবে না।

খুনের বিষয়ে মুন্না বলেন, আদালতে রাকিব স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বলেছে, সে নাকি ঋণগ্রস্ত। পাওনাদাররা তাকে মামলার হুমকি দিয়ে আসছিল। তখন সে চিন্তা করে, হাজতে গেলে স্ত্রী-সন্তানদের কী হবে? এ কারণে ওদের হত্যা করে। বলেছে, সেও নাকি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু, তার ভেতর সে রকমের কোনো লক্ষণ দেখিনি। প্রথমে সে মুন্নীর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে এবং পরে গলা টিপে হত্যা করে। টিভি দেখার সময় রশি দিয়ে লাইবার গলায় পেঁচিয়ে হত্যা করে। ছেলে ফারহান উদ্দিন বিপ্লব তার অন্য রুমে ঘুমাচ্ছিল। রাকিব জুতার ফিতা দিয়ে ছেলের গলা পেঁচানোর সময় ছেলে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। অনেক হাউমাউ করে কাঁদে। ছেলেটি বলে, ‘বাবা, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে?’ তারপর জোর করে ছেলেটির গলায় রশি পেঁচিয়ে ধরে। রাকিব ভয়ঙ্কর কিলার। কিভাবে সে একে একে তিনটা তাজা প্রাণ কেড়ে নিলো।

রাকিবের ঋণগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মুন্না আহম্মেদ বলেন, রাকিবের কয়েকজন বন্ধু বলেছে, সে অনলাইনে জুয়া খেলত। এভাবে সে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়। শেষ মুহূর্তে আমাদের কাছে টাকা চেয়েছিল। কিন্তু, এত টাকা পাব কোথায়? আমরা বলেছিলাম, তোমার চাকরি প্রায় শেষের দিকে। পেনশনের ৫০ লাখ টাকা পাবে। ওই টাকা দিয়ে কিছুটা ঋণ শোধ করবে। যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছ, তাদের বুঝিয়ে বলবে। সময় নিয়ে আস্তে আস্তে দিয়ে দেবে। আমাদের ধারণা—টাকা না পেয়ে হয়ত এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

বোনকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন মুন্না আহম্মেদ। তিনি বলেন, তিন বোনের মধ্যে ও (মুন্নী) ছিল সবার ছোট। বড় বোনদের জন্য আমার কিছু করতে হয়নি। কিন্তু, ও তো ছোট ছিল। ওকে স্কুল-কলেজে নিয়ে যাওয়া। ছোট-খাট আবদার মেটানো। অনেক সময় সাধ্যের বাইরে গিয়েও চেষ্টা করেছি আবদার মেটানোর। সেই বোনকে, ভাগ্নে-ভাগ্নিকে কি নির্মমভাবে খুন করেছে। রাকিবের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। ওর যেন ফাঁসি হয়।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মাহবুবুর রহমান জানান, আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছি। আশা করছি, তার সর্বোচ্চ সাজা হবে।

২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দক্ষিণখানের ৮৩৮ নম্বর ‘প্রেম বাগান’ নামক ভবনের চতুর্থ তলার বাসা থেকে মুন্নী বেগম (৩৭) এবং তার দুই সন্তান ফারহান উদ্দিন (১২) ও লাইবা রহমানের (৩) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিন সকাল থেকেই ওই ভবনের বাসিন্দারা পচা গন্ধ পাচ্ছিলেন। প্রথমে অনেকেই ভেবেছিলেন, হয়ত মৃত পশু-পাখি থেকে গন্ধ আসছে। কিন্তু, আশপাশে খুঁজেও সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি। তাই, সন্দেহ বাড়তে থাকে।

এছাড়া, নিহত মুন্নীর ভগ্নিপতি সোহেল আহম্মেদ কয়েকদিন ধরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। এতে সবার সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। ওই দিন সকালে সোহেল আহম্মেদ তাদের খুঁজতে আসেন দক্ষিণখানের ওই বাসায়। এসে ঘরের দরজা বন্ধ পান।

পরে বাড়ির মালিকের সঙ্গে পরামর্শ করে চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন তারা। দেখতে পান, মুন্নী বেগম ও তার মেয়ে লাইবার মরদেহ একটি রুমের বিছানার ওপর পড়ে আছে। অন্য কক্ষের মেঝেতে পড়ে আছে ফারহান উদ্দিনের মরদেহ। এরপর পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পরে দক্ষিণখান থানা পুলিশ এসে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top