গ্যাস বেলুন: ছোট-বড় সবার হাতে যেন ‘হাইড্রোজেন বোমা’

balon-20220923191138-1.webp

নিজস্ব প্রতিবেদক….

শিশুদের পছন্দের খেলনা বাহারি রঙের বেলুন। জন্মদিনসহ আমাদের যে কোনো উৎসব চলে না বেলুন ছাড়া। বিভিন্ন সভা-উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও বেলুন উড়িয়ে করা হয় শুভ সূচনা। বাসায় মুখের বাতাসে বেলুন ফোলালেও দ্রুত ফোলানোর জন্য ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করেন গ্যাস। এই গ্যাসে ভরা বেলুন সহজেই আকাশে ওড়ে। বেলুন ফোলাতে বিশ্বব্যাপী ব্যবহার করা হয় হিলিয়াম গ্যাস। এই গ্যাস ব্যবহার করা নিরাপদ। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে হাইড্রোজেনযুক্ত গ্যাস, যা ডেকে আনছে ভয়ংকর বিপর্যয়।

সম্প্রতি গাজীপুর জেলা পুলিশ লাইন্স মাঠে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে ঘটেছে ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা। যেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন ও আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদসহ অনেকে। প্রধান অতিথির হাতে দেওয়া বেলুনগুচ্ছ না ওড়ায় মঞ্চের পেছনে নিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। বিক্রেতাকে বকাঝকা করলে আগুন লাগিয়ে ওড়ানোর চেষ্টা করেন। এতে বিস্ফোরণ ঘটে দগ্ধ হন পাশে বসে থাকা জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা আবু হেনা রনি ও পুলিশ কনস্টেবলসহ পাঁচজন। পরে রনিকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, বেলুনগুলো আমাদের সামনেও বিস্ফোরণ হতে পারতো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাইড্রোজেন দিয়ে বেলুন ফোলানোর ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশে প্রক্রিয়া বন্ধ করার ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। প্রতি বছরই হাইড্রোজেনযুক্ত গ্যাস বেলুন ফেটে অথবা হাইড্রোজেন গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হিলিয়াম গ্যাসের আমদানি মূল্য বেশি বলে কম মূল্যে বেলুন বিক্রির জন্য বিক্রেতারা নিজেরাই হাইড্রোজেন গ্যাস বানিয়ে সিলিন্ডারে ভরছেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ইয়াসির আরাফাত খান জাগো নিউজকে বলেন, গ্যাস বেলুনে হিলিয়াম ব্যবহার করার কথা। হাইড্রোজেন গ্যাস বিক্রির জন্য বাংলাদেশে খুব বেশি অর্গানাইজেশন নেই। তবে বেলুন বিক্রেতারা তাদের কাছ থেকে হাইড্রোজেন না নিয়ে নিজেরা নিজেদের মতো হাইড্রোজেন তৈরি করে। অনেক ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরির সময় বিস্ফোরিত হয়েও হতাহত হয়।

তিনি আরও বলেন, হাইড্রোজেনের ক্ষতিকর ও উপকারী দুটি দিকই আছে। ল্যাবরেটরিসহ বিভিন্ন বিশ্লেষণে হাইড্রোজেন ব্যবহার করা হয়। বোমা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এই গ্যাস। বোমা যখন বিস্ফোরিত হয় তখন প্রচুর এনার্জি রিলিজ করে। হাইড্রোজেন অক্সিজেনের সঙ্গে রিঅ্যাকশন করার ফলে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। হাইড্রোজেন গ্যাস কিংবা হাইড্রোজেন বোমা মারাত্মকভাবে ক্ষতি করতে পারে।

বিস্ফোরক অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এক সিলিন্ডার থেকে আরেক সিলিন্ডার বা অন্য কিছুতে গ্যাস ভরা মারাত্মক অপরাধ। আর বেলুনের গ্যাস শিশুসহ সব বয়সী মানুষের জন্য বিপজ্জনক। সিলিন্ডার থেকে অন্য সিলিন্ডার বা অন্য কিছুতে ট্রান্সফার করার কারণে আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে। যার কারণে প্রায়ই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটে।

বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সাধারণত দুই কারণে আগুন ধরে যেতে পারে। প্রথমত, সিলিন্ডারটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলে। দ্বিতীয়ত, বেলুনে গ্যাস ভরার সময় অসাবধানতাবশত লিকেজ হলে। যে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা হয়, সেটি গ্যাস ভরার সময় ফুলে যায়, আবার গ্যাস বেলুনে ভরার সময় সিলিন্ডারটি সংকুচিত হয়। বারবার এই সংকুচিত ও সম্প্রসারিত হওয়ার বিষয়টি খালি চোখে দেখা যায় না। সিলিন্ডার মাপলে বোঝা যায়। প্রতিটি সিলিন্ডারের একটা মেয়াদ থাকে। মেয়াদ থাকা অবস্থায় যদি সিলিন্ডারটি ব্যবহার করা হয়, সেক্ষেত্রে সংকোচন বা সম্প্রসারণের ফলে কোনো সমস্যা হয় না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক সুলতানা রাজিয়া বলেন, উন্নত বিশ্বে বেলুনে হিলিয়াম ব্যবহার করার কারণে দুর্ঘটনাও কম হয়। বাংলাদেশ, ভারত ও মালয়েশিয়ায় হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহারের ফলে দুর্ঘটনার খবর আমরা শুনি। হাইড্রোজেন মারাত্মকভাবে বিস্ফোরণ ঘটে। সব সময় বিস্ফোরণ হয় না কারণ বেলুনের মধ্যে থাকার ফলে স্পার্ক হতে পারে না। তবে যদি কোনো কারণে গ্যাস বেলুনের সংস্পর্শে আগুন চলে আসে তাহলে বিস্ফোরণ ঘটবেই। এছাড়া বড় বেলুনে যদি গ্যাসের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে বিস্ফোরণের মাত্রা বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, সামান্য বিনোদনের জন্য বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পেতে গ্যাস বেলুন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। হাইড্রোজেন গ্যাস দিয়ে বেলুন ব্যবহার না করার একটি আইন এখন সময়ের দাবি।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, হাইড্রোজেন বিস্ফোরক দ্রব্য। হাইড্রোজেন বিস্ফোরিত হলে পুড়ে যায় আবার মানুষ মারাও যেতে পারে। এর ভয়াবহতা অনেক বেশি। সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে এক ধরনের ক্ষতি হতে পারে, আবার ট্যাংকার বিস্ফোরিত হলে আরেক ধরনের ক্ষতি হতে পারে। হাইড্রোজেনের ইউএন নম্বর ১০৪৯। হাইড্রোজেন গ্যাসের সংস্পর্শে হিট হলে বিস্ফোরণ ঘটে। হাইড্রোজেনের সংস্পর্শে দিয়াশলাই, সূর্যের তাপে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা থাকে। বেলুনে হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহারের কথা থাকলেও কম দামি হওয়ায় হাইড্রোজেন ব্যবহার করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

তিনি বলেন, যারা গ্যাস সরবরাহ করে তাদের ধরলে কারা হাইড্রোজেন ব্যবহার করে শনাক্ত করা যাবে। যে কোনো নাশকতায় হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করতে পারে। এ কারণে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে।

গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণে শুধু আবু হেনা রনিই নন, এর আগেও দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত র্যালিতে যোগ দিতে যাওয়ার সময় বাসের মধ্যে গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণে ১০ জন অগ্নিদগ্ধ হন। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় রাইদা পরিবহনের একটি বাসে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তাদের সবার কাছে গ্যাস বেলুন ছিল। হঠাৎ করে গ্যাস বেলুনগুলো বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে।

২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার রূপনগরে বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় সাত শিশুর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আহত হয়েছিল আরও প্রায় ২০ জন। সে সময় বেলুনে অবৈধ হাইড্রোজেন ব্যবহার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top